অনিন্দ্য সুন্দর কাপ্তাই হ্রদ। কিন্তু রাঙামাটি শহরের যেকোনো ঘাট থেকে নৌকায় উঠে তীর ঘেঁষে চলতে থাকলে চোখে পড়বে এর বিপরীত দৃশ্য। সারি সারি দালানকোঠা তীর ছেড়ে হ্রদের অনেকটুকু জায়গা দখলে নিয়েছে। তীরের কাছাকাছি হ্রদের জলে ভাসতে দেখা যাবে আবর্জনা ও বর্জ্য। দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়। কোথাও কোথাও কচুরিপানার রাজত্ব। দখল ও দূষণে কাপ্তাই হ্রদের এখন হাঁসফাঁস অবস্থা।
রাঙামাটি পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের আয়তন ৬৪ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এর অর্ধেকই হ্রদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। শহরে কাঁচা-পাকা বাড়িগুলো নিজেদের মতো হোল্ডিং ব্যবহার করছে। এই হোল্ডিংয়ের হিসাবে বাড়ির সংখ্যা ১৮ হাজার ৪৭টি। অথচ এর মধ্যে পৌরসভার অনুমোদিত হোল্ডিং হলো ১ হাজার ৭৩৭টি। বাকি ১৬ হাজার ৩১০টি কাঁচা-পাকা বাড়ি অবৈধ। এর মধ্যে হ্রদ দখল করে গড়ে উঠেছে সাড়ে ৪ হাজার বাড়িঘর। শহরের বিভিন্ন বাড়িঘরে শৌচাগারের সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৪৫টি। এর মধ্যে ৪০ ভাগ শৌচাগারের বর্জ্য সরাসরি হ্রদে গিয়ে পড়ছে।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, যেভাবে দখল ও দূষণ বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে কাপ্তাই হ্রদের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়বে। হ্রদের তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধেও কারও কোনো উদ্যোগ নেই। হ্রদের পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ দখলদারেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। হ্রদের স্থাপনা বেড়ে যাওয়ায় দূষণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে ও হ্রদের ভেতরে নির্মাণ করা বসতবাড়ি থেকে মলমূত্র ও বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলা হচ্ছে। অথচ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ এই পানিই শহরে সরবরাহ করছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা শাইনিং হিলের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ দখলদার ও বর্জ্য ফেলার কারণে কাপ্তাই হ্রদ এখন হুমকির মুখে। হ্রদ ও হ্রদের পাড়ে গড়ে ওঠা বসতবাড়িগুলোর কয়েক হাজার শৌচাগারের বর্জ্য সরাসরি হ্রদের পানিতে ফেলা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছর পর হ্রদের পানি ব্যবহার করা যাবে না।
সরেজমিনে শহরের রিজার্ভ বাজার এলাকায় দেখা গেছে, এখানকার হ্রদের তীরবর্তী চার কিলোমিটার এলাকায় শত শত কাঁচা-পাকা বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। রয়েছে এক থেকে তিনতলা পর্যন্ত পাকা ভবন। অনেক ভবনের নিচের অংশ হ্রদের পানিতে ডুবে রয়েছে। শহরের বনরূপা, বাস টার্মিনাল, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, তবলছড়ি, পুলিশ লাইন্স, আসামবস্তি, পাবলিক হেলথ কলেজ গেট, পৌরসভা কার্যালয় এলাকা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এলাকা, হাসপাতাল এলাকা, কাঁঠালতলীসহ অন্তত ২৫টি এলাকায় গিয়ে একই চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় হ্রদের পাড়ে লম্বা গাছের খুঁটি গেড়ে অসংখ্য বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের কারণে ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদের। সারা বছর ২০ হাজার জেলে এই হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করেন। হ্রদ হওয়ার পর থেকে জেলা সদরের সঙ্গে ছয় উপজেলা নৌ যোগাযোগও গড়ে ওঠে।
রিজার্ভ বাজার এলাকায় মো. মনিরুজ্জামান ও বনরূপা এলাকায় তরুণ বিকাশ চাকমা হ্রদের পাড় দখল করে ঘর তুলেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘শহরে বসতঘর তৈরির কোনো জায়গা নেই। তা ছাড়া আমাদের অল্প আয়ে এত দাম দিয়ে জায়গা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই হ্রদের পাড়ে ঘর নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছি।’
রাঙামাটি পৌর মেয়র মো. আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হ্রদের পাড়ে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জেলা প্রশাসনের। পৌরসভা শুধু বৈধ নথিপত্র দেখে বাড়িঘর ও ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে সব স্থাপনা অবৈধ। শিগগিরই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তবে কী পরিমাণ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য নেই। এ বিষয়ে পৌরসভাকে অবৈধ স্থাপনা নিরূপণ করার জন্য বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন কাপ্তাই হ্রদকে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। হ্রদ রক্ষা করার জন্য ইতিমধ্যে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।