ঢাকা কাল ছিল সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর

ধুলায় আচ্ছন্ন চারদিক। ভোগান্তিতে পথাচারীরা। দূষণ থেকে কোলের শিশুটিকে বাঁচাতে কাপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিচ্ছেন অভিভাবক। গতকাল বিকেলে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায়। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ধুলায় আচ্ছন্ন চারদিক। ভোগান্তিতে পথাচারীরা। দূষণ থেকে কোলের শিশুটিকে বাঁচাতে কাপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিচ্ছেন অভিভাবক। গতকাল বিকেলে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায়।  ছবি: সাইফুল ইসলাম

ভারতের রাজধানী দিল্লির বায়ুদূষণের খবর এ মাসের শুরুতে বেশ কয়েকবার বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। দূষণের কারণে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে। গতকাল রোববার রাত পৌনে নয়টায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে দিল্লির অবস্থান ছিল চতুর্থ। দিল্লিকে পেছনে ফেলে তখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম।

ঢাকার দূষণ কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি তুলে ধরেছে বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গতকাল সকাল সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এরপর কয়েক ঘণ্টার জন্য মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর ও ভারতের কলকাতা শহর দূষণের দিক থেকে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায়। তবে রাত সাড়ে আটটার পর ঢাকা আবার শীর্ষে চলে আসে।

ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষকেরা বলছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আট দিন (দিনের বেশির ভাগ সময়) ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এয়ার ভিজ্যুয়াল রাজধানীর সাতটি এলাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার মধ্যে বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল কারওয়ান বাজার এলাকায়। এরপরই মোহাম্মদপুর ও গুলশান এলাকা। এর বাইরে উত্তরা, মিরপুর ও নর্দ্দা এলাকার বায়ুর মানও বেশ খারাপ। এলাকাভিত্তিক বায়ুর মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর বলে জানান গবেষকেরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দেশের ১১টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুরের বায়ুর মান গত শনিবার খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। তুলনামূলকভাবে চট্টগ্রামের বায়ুর মান কিছুটা ভালো ছিল। খুলনা ও কুমিল্লার বায়ুর মান চট্টগ্রামের চেয়ে খারাপ ছিল। বায়ুর মান অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল সিলেট শহরে।

বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়।

দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ রোধে মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। দূষণ ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে অধিদপ্তর; কিন্তু তা দূষণ কমাতে খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে জানান পরিবেশকর্মীরা। আর দূষণের অন্যতম উৎস নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগও তেমন নেই।

এ বিষয়ে পরিবেশসচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকার বায়ুদূষণ সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য সোমবার (আজ) আমরা একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকেছি। সেখানে আমরা সিটি করপোরেশনগুলোসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মতামত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’

পরিস্থিতি অনুযায়ী উদ্যোগ কম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। গতকাল রাত নয়টায় ঢাকার বায়ুর মানের গড় সূচক ছিল ২২০। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার এলাকার বায়ুর মান ছিল ২৯৮, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। কোনো শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০ ছাড়ালে ওই শহরের মানুষকে মাস্ক (মুখোশ) পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হয়, সাইকেলে চড়া নিষেধ করা হয়। আর শিশু ও বৃদ্ধদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

>সকাল সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।
ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য মূলত দায়ী শহরের আশপাশের ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলা।

ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, চীনের বেইজিং শহরে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছে গেলে সেসব দেশের সরকার বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা জারি করে। নাগরিকদের বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ।

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের উপকর্মসূচি পরিচালক শাহ নেওয়াজ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দ না থাকায় শহরে ঘরের বাইরের বায়ুদূষণ নিয়ে তাঁদের কোনো কার্যক্রম আপাতত নেই।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রুলসহ আদেশ দেন। ধুলা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর রাস্তাসহ নির্মাণাধীন জায়গা ঘিরে দেওয়া, ধুলামাখা স্থানে দুই বেলা পানি ছিটানো এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর বায়ুর মান এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে এই শহরে এখন পরিবেশগত জরুরি অবস্থা জারি করার সময় চলে এসেছে।

দূষণের উৎস বাড়ছে
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে চলতি বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংক। তাতে দেখা যায়, দেশে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ। আট বছর ধরে এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে দেশের ইটভাটাগুলোর ওপরে একটি জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, দেশে ইটভাটার সংখ্যা ৪ হাজার ৯৫৯। পরে ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৯০২ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৮৭টি ইটভাটা ঢাকা বিভাগের মধ্যে গড়ে উঠেছে।

ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে মোট যানবাহনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৭। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৪।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের এদেশীয় পরিচালক রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণ মোকাবিলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এই দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।