>
- পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ
- দূষণকারী পদার্থ ছড়াচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে
- দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই সরকারি
- দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে কয়েকবার তাগিদ অধিদপ্তরের
- অধিদপ্তরের তাগিদে কেউই তেমন সাড়া দেয়নি
গত বছর ১৯৭ দিন রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসে ডুবেছিল। আগের বছরগুলোতে রাজধানীর বাতাস বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২০ থেকে ১৬০ দিন দূষিত থাকত। অর্থাৎ ঢাকার বায়ুদূষণ সময়ের বিবেচনায়ও বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীর বাতাসে দ্রুত দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে। আর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই সরকারি। পরিবেশ অধিদপ্তর এদের কয়েকবার চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে। কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দূষণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলো হলো মেট্রোরেল নির্মাণকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ (উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত), ২০ তলা নির্মাণাধীন জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ কর্তৃপক্ষ, ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর এবং দক্ষিণ, ঢাকা ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল সম্প্রসারণ কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২৪ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবন কর্তৃপক্ষ, ভূগর্ভস্থ কেব্ল লাইন প্রকল্প, ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর)–এর আগারগাঁও রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ১৪ তলা বিটিইবি ভবন-২ প্রকল্প, নির্মাণাধীন বিটিআরসি ভবন, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্মাণাধীন ১৩ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। দূষণ ছড়ানোর তালিকায় আছে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত নির্মাণকাজও।
অধিদপ্তর এদের চিঠি দিয়ে দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু কেউই তেমন সাড়া দেয়নি। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় সভায় ডাকা হলেও বেশির ভাগ সংস্থা তাদের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে দায় সেরেছে। অনেকে তা–ও করেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, গত চার বছর ধারাবাহিকভাবে দূষণের সময় বা দিন বাড়ছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীর বাতাস দূষিত থাকে। সবচেয়ে বেশি দূষণ থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, মার্চ ও এপ্রিলের বাতাসও জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসের মতো খারাপ থাকছে। এর আগে এপ্রিলে এসে বাতাসের মান মোটামুটি ভালো অবস্থায় ফিরত। কিন্তু গত বছরের এপ্রিল মাসেও রাজধানীর বাতাস খুবই খারাপ ছিল।
পরিবেশ গবেষক আতিক আহসানের একটি চলমান গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু অস্বাস্থ্যকর থেকে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১৭৩ দিন, ২০১৬ সালে ১২৯ দিন, ২০১৭ সালে ১৮৫ দিন ও ২০১৮ সালে ১৯৭ দিন ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে প্রতিদিন ঢাকার বায়ুর মান পরীক্ষা করা হচ্ছে।
প্রতিটি বড় প্রকল্পে দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিক দুর্ভোগ এড়ানোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তা ন্যূনতম পর্যায়েও মানছে না। ধুলা নিয়ন্ত্রণে ঠিকমতো পানি ছিটানো ও কর্মক্ষেত্রের চারপাশ ঘিরে রাখার কাজও করছে না তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মহসীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চলতি মাসের শেষে বা সামনের মাসের শুরুতে সংশ্লিষ্ট সবগুলো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবদের নিয়ে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে আলোচনা করব।’ তিনি বলেন, ‘দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমাদের সাতজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকার কথা। কিন্তু আছে একজন। দূষণ হচ্ছে রাজধানীর বিশাল এলাকাজুড়ে। চাইলেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছি না।’
তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি পরিবেশ অধিদপ্তর আগে দূষণকারীদের জরিমানা করত ও অভিযান পরিচালনা করত। বিদ্যমান আইন দিয়েই তা করা হতো। কিন্তু এখন দূষণ বাড়লেও অভিযান কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় আছে।’
এ ব্যাপারে পরিবেশসচিব বলেন, ‘এখন আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এত দিন আমাদের কোনো স্বতন্ত্র আইন ছিল না। আমরা একটা নতুন আইন তৈরি করছি, সেটি সংসদে অনুমোদন হলে আমরা এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারব।’
সাবের হোসেন চৌধুরী এ–ও বলেন, সবগুলো অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দূষণ নিয়ন্ত্রণে আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকে। বেশির ভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই টাকা খরচ না করে একে মুনাফায় রূপান্তর করে। এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় ১৩ মার্চ হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আগামী ১০ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (ডিজি) তলব করেছেন আদালত। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করে এবং দূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদনও দিতে হবে ডিজিকে। আদালত বলেছেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপ আমাদের হতাশ করেছে। আমরা ক্ষুব্ধ।...মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ যেসব এলাকায় চলছে, সেসব এলাকায় প্রচুর ধুলাবালি পরিবেশকে দূষিত করছে। আমাদের মেট্রোরেল প্রয়োজন। কিন্তু একই সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধও জরুরি। আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হলে এসব (বায়ুদূষণ) বন্ধ করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাবে, বিশ্বে বায়ুদূষণের কবলে থাকা রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এই শহরের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তু কণিকার (পার্টিকুলেট মেটার বা পিএম ২.৫) পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণ যে একটি বড় বিষয় এবং তা নাগরিকদের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে, সে ব্যাপারে সরকারি সংস্থাগুলোর কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। দূষণকারীদের থামানো ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। এটা নাগরিকদের প্রতি বড় ধরনের অন্যায়।