ঝড়ের সময় জনবসতিকে আগলে রেখে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেয় সুন্দরবন, এটি কম-বেশি জানা তথ্য। তবে দুর্যোগের সময় টাকার অঙ্কে সুন্দরবন জনবসতির ক্ষতি কতটা কমায়—এ ধরনের কোনো গবেষণা এত দিন ছিল না। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো দেখানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি ২৬ লাখ টাকার (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) সম্পদ বাঁচিয়েছে।
সিডরের ক্ষয়ক্ষতি ও সুরক্ষার আর্থিক মূল্য নির্ধারণের জন্য গবেষক দল সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকা বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার পাশাপাশি সুন্দরবনবিহীন বরগুনায় ১ হাজার ৫২৫টি বসতঘরের ওপর জরিপ চালায়। এসব বসতঘরের অর্ধেক ছিল সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার এবং বাকিগুলো ছিল সুন্দরবনবিহীন এলাকায়।
গবেষণায় বলা হয়, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার চেয়ে বরগুনা জেলার প্রতি বসতিতে সিডরের সময় গড়ে ১৫ হাজার ২৭৮ টাকার ক্ষতি বেশি হয়। সুন্দরবনের কারণে বরগুনার চেয়ে ওই তিন জেলার প্রতি বসতিতে সমপরিমাণ টাকার ক্ষতি কম হয়। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত সুন্দরবনের বলেশ্বর নদের ওপর দিয়ে সিডর প্রবাহিত হয়। এই নদীর এক পাশে সুন্দরবন এবং অন্য পাশে বরগুনা জেলা (বন থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে)।
‘সিডর’ গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা সিডরে প্রাণ হারায় ৩ হাজার ৪০৬ জন। আহত হয় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া, মাছ ও ফসল নষ্ট হওয়া, গাছ পড়ে আহত হওয়াসহ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮৯ লাখ মানুষ। গবেষকেরা বলছেন, ৬ লাখ ৩ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট ‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালনা করে। বিশ্বজুড়ে কৃষি, মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে উইনরক। সুন্দরবন নিয়ে করা এই গবেষণায় আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএসএইড এবং জন ডি রকফেলার ফাউন্ডেশন। ২০১৪ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া এই গবেষণা তিন বছর পর গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এ এইচ এম রায়হান সরকার। গবেষক দলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নূর নবী ও আইইউসিএন বাংলাদেশের জিআইএস অ্যানালিস্ট ইমরান হাসান। গবেষণায় সহায়তা করেন স্পারসোর (মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মেহেরুন নেসা।
গবেষণা দলের প্রধান রায়হান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় সিডরের গতি কমে যায় এবং গতিপথেরও পরিবর্তন হয়। সিডরের গতিপথ ছিল সুন্দরবনের দিকে। পরে এটি গতিপথ পাল্টে ডান দিকে বাঁক নিয়ে বরিশাল বিভাগের দিকে চলে যায়। সিডর সুন্দরবনে আঘাত হানলেও প্রচুর পরিমাণ গাছ থাকার কারণে শক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, গত ১০০ বছরে বঙ্গোপসাগরে ৫০৮টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর ১৭ শতাংশ আঘাত হানে বাংলাদেশে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে যত ঝড় বয়ে গেছে, প্রতিবারই মানুষের জীবন ও সম্পদকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে সুন্দরবন।
গবেষক দলের সদস্য মোহাম্মদ নূর নবী বলেন, সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় সিডর যেভাবে ওই অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদকে রক্ষা করেছে, তার থেকে শিক্ষা নেওয়া খুবই প্রয়োজন।
ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়নের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা। একই সঙ্গে সুন্দরবন-সংলগ্ন ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে চিংড়ি চাষ এবং সুন্দরবন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করতে বলেছেন তাঁরা।
গবেষকেরা বলেন, চিংড়িঘেরগুলোর কারণে সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীতে লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণাক্ততার কারণে নদীতে জলজ প্রাণীর পরিমাণ কমে যাচ্ছে। চিংড়িঘেরগুলোর জায়গায় ম্যানগ্রোভ করা হলে এটি সবুজ বেষ্টনী হিসেবে কাজ করবে। এতে সুন্দরবনের সম্পত্তিও রক্ষা পাবে।
এই গবেষণার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমীন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের সব ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষার ক্ষেত্রে এটি ভিত্তি হতে পারে। সুন্দরবনের আর্থিক মূল্যায়নের একটি চিত্র পাওয়া গেছে এই গবেষণায়। সরকার চাইলে দেশের অন্যান্য বনের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে এই গবেষণার সাহায্য নিতে পারে।
সুপারিশ: ঘূর্ণিঝড় থেকে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকায় জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করার জন্য গবেষক দল বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা। এ দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষ বনায়ন করারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। কৃষি, নগর উন্নয়ন কিংবা অন্য কোনো কাজের জন্য ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় প্যারাবন কোনোভাবেই নষ্ট ও ধ্বংস না করার কথা বলেছেন গবেষকেরা। সুন্দরবন-সংলগ্ন যেসব এলাকায় চিংড়ি চাষ হচ্ছে তা সরিয়ে নেওয়া। সুন্দরবনের সীমানা থেকে বাইরের দিকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো ধরনের অবকাঠামোগত স্থাপনা, চিংড়িঘের প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে এই গবেষণায়।