সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ

ঝিমাই পুঞ্জির খাসিদের জমি দখলের চেষ্টা চলছে

জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ঝিমাই পুঞ্জির খাসিদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ঝিমাই পুঞ্জির খাসিদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। ছবি: প্রথম আলো

‘এখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এ নিয়ে সরকার এবং নানা প্রতিষ্ঠান কথা বলে। কিন্তু আমাদের পুঞ্জির শত বছরের গাছগুলো যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে কি পরিবেশ নষ্ট হবে না? জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সোচ্চার মানুষেরা এসব নিয়ে চুপ কেন?’

কথাগুলো একনাগাড়ে বললেন খাসি নারী হেলেনা তালাং। তিনি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকা ঝিমাই পুঞ্জির বাসিন্দা। বসবাসের গ্রামটিকে খাসিরা ‘পুঞ্জি’ বলেন। সেই ঝিমাই গ্রাম পুঞ্জির মানুষেরা আজ বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ভূমি হারানোর আশঙ্কার কথা বললেন। তাঁদের অভিযোগ, ঝিমাই চা-বাগান কর্তৃপক্ষ নানা প্রক্রিয়ায় খাসিদের জমি দখলের চেষ্টা করছে। এই পুঞ্জির ৭২টি খাসিয়া পরিবারকে তারা একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখেছে।
জাতীয় পর্যায়ের ১০টি বেসরকারি নাগরিক সংগঠন এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এগুলো হলো বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, আইপিডিসি, কুবরাজ আন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন, আরডিসি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বেলা, ব্লাস্ট, নিজেরা করি ও এএলআরডি।

সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য পড়ে শোনান বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, প্রায় শত বছর ধরে এই পুঞ্জিতে আছে খাসিরা। তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার ও প্রথাগত জীবনধারাকে বিবেচনায় না নিয়ে সরকার ২০১২ সালে ঝিমাই চা-বাগানের জন্য ৬৬১ দশমিক ৫৫ একর জমি লিজ নবায়ন করে। লিজ দলিলে খাসিদের ভূমিতে বসবাস ও অস্তিত্বের কথা, সমাধি, স্কুল, গির্জা ও জীবিকা নির্বাহের পানজুমের গাছপালার কথা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে। লিজে বলা হয়েছে, এখানে রয়েছে বন ও বাঁশবন। যে পরিমাণ জমি লিজ দেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে ২০০ একরের বেশি জমি বাগান কর্তৃপক্ষ দখল করে রেখেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাগান সম্প্রসারণের জন্য ২ হাজার ৯৬টি গাছ কাটার জন্য কর্তৃপক্ষ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পায়। খাসিরা উচ্চ আদালতে যায়। আদালত অপরিপক্ব গাছ না কাটা, গাছ কাটার আগে একটি গাছের বিপরীতে দুটি চারা রোপণ, রোপিত নতুন চারা অন্তত তিন বছর যত্ন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণ পাশ কাটিয়ে চা-বাগানের লোকজন গাছ কাটার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ঝিমাই চা-বাগান কর্তৃপক্ষ খাসিদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে। পুঞ্জিতে ঢোকার মূল সড়কটি ফটক নির্মাণ করে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আগে পুঞ্জির পাদদেশ পর্যন্ত গাড়ি যেত। এখন ফটকেই গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়। অসুস্থ রোগীকে বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত ভেতরে নিতে দেওয়া হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ঝিমাই পুঞ্জি থেকে অন্যায়ভাবে খাসিদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে। আস্থাহীনতায় ভোগা এসব মানুষকে চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে। তাদের পক্ষে দাঁড়ানো একটি নাগরিক কর্তব্য। এই পুঞ্জির সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন দরকার।
অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভূমি গ্রাসের চেষ্টা একের পর ঘটছে। ঝিমাই চা-বাগানের এসব ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘ঝিমাই খাসি পুঞ্জির ভূমিসংক্রান্ত সমস্যাটি অনেক পুরোনো। এ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনেক আগে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সংখ্যায় কম খাসিদের মতো জাতিগোষ্ঠীর ভূমির সমস্যা যখন আসে, তখন আমাদের মন্ত্রণালয়গুলো ঘুমায়।’

নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবিরের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাপার সহসভাপতি আবদুল মতিন, বাপার নির্বাহী সদস্য ফাদার যোসেফ গোমেজ, ঝিমাই পুঞ্জির মন্ত্রী (হেডম্যান) রানা সুরং, পুঞ্জির অধিবাসী কুইলবং সুরং প্রমুখ।

ঝিমাই বাগান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
ঝিমাই খাসি পুঞ্জি থেকে খাসিদের উচ্ছেদ ও তাদের জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাগানের ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, খাসিদের সঙ্গে কোনো অন্যায্য আচরণ করা হয়নি। বরং বাগানের ৩৭১ একর জায়গা খাসিদের দখলে।

মনিরুজ্জামান বলেন, বাগানের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রবেশ ফটক আছে, সেখানে যান চলাচল করতে দেওয়া হয় না। ফটকে গাড়ি রেখে খাসিরা তাদের পুঞ্জিতে ঢুকতে পারে। জরুরি পরিস্থিতিতে অবশ্য গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হয়।
গাছ কাটার বিষয়টি নিয়ে বাগানের ব্যবস্থাপক বলেন, আদালতের নির্দেশ আছে গাছ কাটার বিষয়ে। কিন্তু খাসিদের বাধার মুখে তা হয়নি।