অধিকাংশ জলাভূমিই সুরক্ষিত নয়। এসব জলাভূমিতে কী পরিমাণ জীববৈচিত্র্য এবং হুমকি রয়েছে, তা–ও অজানা।
যে মনে জল, যে প্রাণে কৃষি—তার আশা, নিরাশা, অস্তিত্ব ও সংগ্রামশীলতার বয়ানই বাংলাদেশ। ‘বিস্তীর্ণ দুপারে, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে’ গঙ্গা বইছে! আজ ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী জলীয় পরিবেশ রক্ষার সম্মিলিত প্রয়াস রামসার সম্মেলনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এ বছরই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কেমন আছে মুক্ত এ দেশের মাছ, পাখি, গাছগাছালিসহ অসংখ্য প্রাণ? নৈসর্গিক জলাভূমিকে মানুষ রেখেছে কেমন?
বাংলাদেশের জলাভূমি হাওর, বাঁওড়, বিল ও ঝিল নিয়ে গঠিত। ভূকম্পের ফলে সৃষ্ট বিশাল গামলা আকৃতির জলাশয়কে বলে হাওর। বাঁওড় হলো পুরোনো নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট জলাশয়। পুরোনো নদীর গতিপথের ধার ঘেঁষে সৃষ্ট জলাধারই বিল। নদীর পরিত্যক্ত খাতকে ঝিল বলে।
উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের জলাভূমিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, জলাভূমিগুলো দেশের মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত। জলাভূমির আয়তন কমে এখন ৪৫ দশমিক ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমিতে প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জলাভূমি ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলনিষ্কাশন ও সেচে’ হারিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে বিভিন্ন দেশ জলাভূমি রক্ষা ও টেকসই ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সুন্দরবন ১৯৯২ সালে রামসার অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও মানবসৃষ্ট মারাত্মক হুমকিতে সুন্দরবন ও তার জীববৈচিত্র্য।
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ২০০০ সালে রামসার অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। টাঙ্গুয়ার হাওরে বিরল প্রজাতির ২ শতাধিক পাখির অভয়াশ্রম এবং বিপন্ন ১৫০ প্রজাতির মাছের সমাগম। সরকার টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণ ও বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিয়ে সুফল পেলেও বিভিন্ন মানবসৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ঠেকানো যাচ্ছে না।
জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হাকালুকি হাওরকে তৃতীয় রামসার অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২৩৮টি স্বতন্ত্র বিলসহ এর আয়তন ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর। হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ, ৫২৬ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে।
বায়েরের ভূতিহাঁস গোটা পৃথিবীতে মহাবিপন্ন প্রজাতি। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের মতে, পৃথিবীতে মাত্র ২০০ জোড়া বায়েরের ভূতিহাঁস টিকে আছে। শীতকালের পরিযায়ন মৌসুমে এ হাঁসটি হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। বায়েরের হাঁসের মতো আরও প্রায় ২০ জাতের বিভিন্ন প্রজাতির ২-৩ লাখ হাঁস হাওর এলাকার জলাশয়গুলোতে আসে। পাখিশুমারির বিভিন্ন তথ্য বলছে, প্রতিবছরই পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ কমছে। অবৈধভাবে বুনো হাঁস শিকারে ফাঁদের ব্যবহার তুলনামূলক কমলেও ধানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে জমিতে রাখায় পরিযায়ী হাঁস মারা পড়ে। গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি হাঁস মারা পড়েছে হাকালুকি হাওরে। বিষে মরা হাঁসগুলো বাজারে বিক্রি হওয়ায় জনস্বাস্থ্যও হুমকির সম্মুখীন।
জলাভূমির হালনাগাদ তথ্য নেই। মোট ৩৭৩টি জলাভূমির আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। অধিকাংশ জলাভূমিই সুরক্ষিত নয়। এসব জলাভূমিতে কী পরিমাণ জীববৈচিত্র্য এবং হুমকি রয়েছে, তা–ও অজানা। বেশির ভাগ জলাভূমি সংরক্ষিত না থাকায় আইইউসিএনের গবেষণা অনুযায়ী পরিযায়ী পাখির বিচরণ ক্রমশ সংরক্ষিত এলাকায় সীমিত হয়ে আসছে।
সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজনে জলাভূমি সরকারিভাবে সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে। সরকার বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের সৃষ্টি করলেও কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়। সব জলাভূমি সংরক্ষণ করা গেলে পরিযায়ী পাখি এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্যও নিরাপদ হবে।
জলাভূমি কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জন্য বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্র। শুধু হাওর অঞ্চলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দশমিক ৭২০ লাখ হেক্টর। প্রতিবছর ৫০ লাখ টনের বেশি ধান উৎপাদিত হয়, মূলতই বোরো। আন্তদেশীয় পানি বণ্টনের বৈষম্যমূলক প্রভাবে অসময়ে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে হাওর অঞ্চল। উচ্চফলনশীল ধানের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে অভিযোজিত দেশি জাত হারিয়ে যাচ্ছে। জলাভূমিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরও চাপ পড়ছে।
হাওর অঞ্চলে আছে ১৪০ প্রজাতির মাছ। গত এক দশকে এসব মাছের মধ্যে প্রায় ৬২টি প্রজাতির অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে পাঙাশ, সরপুঁটি, রিঠা, শিশর, মহাশোল, একথুটি, বামোশ, বাগাড়, পিপলা, তিলা শোল, ঘাউড়া, বাচা, বাটা, কালিয়া, ঘইন্যা, শাল বাইম, কুমিরের খিল, গুইজ্জা, চিতল, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, রানি, চাকা, গজার, কাশ খাউড়া, কালাবাটা, নেফতানি, ডানকুনি, ঢ্যালা, বিষতারা, শিলং, গুজি আইড়, ছেপ চেলা ও রায়েক, কানি পাবদা, মধু পাবদা, পাবদা প্রধান।
অধিক ফলনের আশায় জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে জলজ প্রাণী ক্ষতির শিকার। এখন ভরা মৌসুমও মাছ পাওয়া যায় কম। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করায় এবং জলাভূমি দখল হওয়ায় বাধা পড়েছে পানি নিষ্কাশনে। ফলে জলবদ্ধতা বাড়ছে।
দিন দিন জলাভূমি দখল হয়ে পড়ছে, বহু জলাভূমি চলে যাচ্ছে ব্যক্তিমালিকানায়। আইনে বলা হয়েছে, উন্মুক্ত জলাধার ইজারা দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র টাঙ্গুয়ার হাওর বাদে অন্য সব জলাশয়ে ইজারাপ্রথা বিদ্যমান। ‘জাল যার জলা তার’, নীতিবাগীশ কথা হয়েই থাকছে। প্রকৃত মত্স্যজীবীরা ইজারা পাচ্ছেন না। আগে ছোট ছোট বিল ইজারা দেওয়া হতো না। অতীতে প্রজননের জন্য কিছু মাছ রেখে দেওয়া হতো। সব বিল ইজারা দেওয়ায় মুনাফার লোভে সব ধরনের আহরণ চলছে।
আশার কথা, হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ (লিভিং এনটিটি) বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যান্য অনেক দেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা সংকট মোকাবিলার মাধ্যমে পৃথিবীর সুরক্ষা ও হেফাজতের লক্ষ্যে ‘গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা’র প্রস্তাব সংসদে পাস হয়েছে।
জলাভূমি বাঁচাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। দেশের সব জলাভূমির সংরক্ষণই জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, প্রথমত জলমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ করে ‘টোকেন ফি’ ব্যবস্থায় জেলেদের মাছ ধরার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জলাভূমির পুরোটা ধান চাষের আওতায় না এনে নির্দিষ্ট এলাকা মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করা দরকার। তৃতীয়ত, হাওরাঞ্চলের বাঁধগুলো ফাল্গুন মাসের মধ্যে মেরামত করে বৈশাখ মাসের শুরুতে হাওরে পানি প্রবেশের সুযোগ দেওয়া কর্তব্য। চতুর্থত, কৃষক ও জেলেদের মূলধন ঘাটতি মোকাবিলায় সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা প্রয়োজন। পঞ্চমত, অন্য দেশ থেকে আসা পানি নিয়মিত পরীক্ষা করে বোঝা দরকার খনির বর্জ্য মাছ ও অন্য জীবের কী ক্ষতি করছে। সেটি নিরূপণ করে তার আন্তদেশীয় সমাধান জরুরি।
সবচেয়ে জরুরি, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথাগত স্থানীয় জ্ঞানের সম্মিলন। এটি না ঘটলে বিপুল অর্থের অপচয় হবে। স্থানীয় মানুষ সংশ্লিষ্ট বাস্তুসংস্থানেরই অংশ। তাঁদের ঐতিহ্যগত পন্থা ও প্রথাগত জ্ঞান ব্যবহার করলে সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার উভয়ই বাড়বে। যেমন, আগে জলাভূমিগুলোতে প্রতি তিন বছরে একবার মাছ ধরা হতো। এ পদ্ধতি ‘পাইল’ নামে পরিচিত। এতে মাছের প্রজনন বাড়ত, মাছ বড় হতো। ইজারার দাপটে পাইলপ্রথা নেই। অনিয়ন্ত্রিতভাবে আহরিত হচ্ছে মাছ।
পানিচক্রের দুটো দিক—মজুত ও প্রবাহ। পানির মজুত অস্থায়ী। জলাশয়ের অস্থায়ী মজুতের পরিমাণ নির্ভর করে মানুষের ওপর। প্রাকৃতিক জলাধারের ওপর অত্যাচার, তথা বাঁধ নির্মাণ, ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে পানিচক্রের ভারসাম্য ও ন্যায্যতা নষ্ট হয়। পানির যথাযথ প্রবাহ না থাকলে জীববৈচিত্র্য ও জীবনযাত্রা হুমকিতে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, শুধু প্রকৌশলভিত্তিক সমাধান, তথা বাঁধ নির্মাণ করলেই পানির যথাযথ মজুত বজায় রাখা সম্ভব নয়। বরং জোয়ারাধার থাকলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশিত হয়ে পলি জোয়ারে ভরাট হয়ে জলবদ্ধতা হয় না।
অবৈধ দখল, আবর্জনা ও রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদির কারণে ভরাট হচ্ছে। যেমন, ঢাকার ৬৫টি খালের মধ্যে ৪৩টি খালই অবৈধভাবে দখলের শিকার এবং ২৪টি খালে পানিপ্রবাহ হয় আংশিকভাবে। ঢাকায় ৮০ শতাংশ পানির জোগান হয় ভূগর্ভ থেকে। বাকি ২০ শতাংশ আসে পৃষ্ঠে প্রবাহিত পানির উৎস থেকে। একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে একুইফারের (নিষ্কাশনযোগ্য ভূগর্ভস্থ পানির স্তর) পানির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের হিসাবে ১৩ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না। ঢাকায় মাত্র ২০ শতাংশ পয়োব্যবস্থাপনার পাইপলাইন রয়েছে, বাকিটা খোলা৷ পাইপলাইনের ৮০ শতাংশেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে৷ পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতেও ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে৷ আবার আগাছানাশক ও কীটনাশক ব্যবহারে পানিদূষণে জলাশয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
নিঃশব্দে নীরবে জলরাশি মানুষকে অবারিত সম্পদ দিয়েই চলেছে। জলাভূমিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা সময়ের দাবি। সাগরমাতা থেকে সাগরে তথা পানিচক্রের প্রতিটি স্তরে ন্যায্যতার জন্য নতুন চুক্তি প্রয়োজন। আন্তদেশীয় পানিপ্রবাহের বৈষম্য নিরসন হলে ভাটির পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান টিকতে পারবে। বাঁধ নির্মাণ, দখল বন্ধ করে পানির মজুত ও প্রবাহের ন্যায্য হিস্যায় প্রয়োজন বহুপাক্ষিকতা।
লেখক: রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর চেয়ারপারসন। আইইউসিএন এশীয় অঞ্চলের সদস্যদের কমিটির ভাইস চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের আইইউসিএন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন।
rt@du.ac.bd