গাবুরার কান্না কি গ্লাসগোতে শোনা যাবে

নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে শুরু হচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। বাংলাদেশকে অবশ্যই সব নীতি-কৌশলের কেন্দ্রে রাখতে হবে জলবায়ু মোকাবিলার কার্যক্রম।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয় গাবুরা ইউনিয়ন। নোনা পানিতে ভেসে যায় বসতঘরসহ মাছের ঘের। গত ২৭ মে দুপুরে

শোঁ শোঁ শব্দে উপকূলে আছড়ে পড়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দানবের রূপ নেয়। জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে ভেসে যায় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাঠঘাট, দোকানপাট। বিধ্বস্ত হয় সড়ক, বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র। মুহূর্তেই জনপদগুলোতে মারা যায় অনেকে। গৃহহীন হয় লাখ লাখ মানুষ। তীব্র ঝড়ে প্রতিবারই লন্ডভন্ড হয় উপকূলের শ্বাসমূলীয় সুন্দরবন। গবাদিপশু, বন্য জীবজন্তুর লাশ ভাসে নদীতে। বনের হরিণ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে আসে লোকালয়ে। সহায়সম্বল ও স্বজন হারানো অগণিত মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আগেই আঘাত হানে নতুন ঝড়ের তাণ্ডব।

সাতক্ষীরা ও খুলনায় ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল, ফণী, আম্পান, ইয়াসের পর পর আঘাতে বহু মানুষের কপোতাক্ষপারের পৈতৃক ভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। সাত পুরুষের ভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বসতঘরে জোয়ারে পানি ওঠায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর অনেককে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে হয়। প্রায় প্রতিবছরই বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ের পর লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বেড়িবাঁধ রক্ষায় স্থানীয়দেরই এগিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এত সমস্যার সমাধান এখনো মিলছে না। দিন দিন দুর্যোগের তীব্রতা ও মাত্রা বেড়েই চলছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার সঙ্গে নিত্য সংগ্রাম করে কোনোরকমে টিকে আছে উপকূলের মানুষ।

১২ বছর আগে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার গাবুরা ইউনিয়ন। গাবুরার এক পাশে উত্তাল প্রমত্তা খোলপেটুয়া নদী, আরেক পাশে খরস্রোতা কপোতাক্ষ নদ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা গাবুরাবাসীর নিত্যসঙ্গী। নদীর অব্যাহত ভাঙনে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে এ জনপদ।

গাবুরাসহ বিশ্বের জলবায়ু বিপন্ন মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশার অভিজ্ঞতার চিত্র উঠে এসেছে ৬৬টি দেশের ১৩৪ জন বিজ্ঞানীর তৈরি করা জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। গত সোমবার জাতিসংঘ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আইপিসিসির প্রতিবেদনটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে আগামী দিনে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার ঘটনা বাড়বে। প্রতিবেদনটি সতর্ক করে দিয়ে বলছে, পরিস্থিতি এখন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ কারণে এমন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, যা গত দুই হাজার বছরেও বিশ্ববাসী দেখেনি।

ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক আছে। শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ সময়ে ভারত মহাসাগর বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ফলে মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। যে কারণে বিশ্বের প্রধান নদী অববাহিকাগুলো এবং এর তীরবর্তী দেশ ও শহরগুলোতে বাড়ছে বন্যা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল—এই এক দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সময়কালের চেয়ে ১ দশমিক শূন্য ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৮৫০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত থাকা রেকর্ড বলছে, গত পাঁচ বছর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম সময়। ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সময়কালের তুলনায় সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির সাম্প্রতিক হার প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। প্রতিবেদন বলা হচ্ছে, ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী হিমবাহগুলো গলে যাওয়া এবং আর্কটিকে সামুদ্রিক বরফস্তর কমে যাওয়ার পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই যে প্রধানত দায়ী, এমন সম্ভাবনা প্রবল (৯০%)।

বিশ্বে যে হারে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তো দূরের কথা, দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। মূল কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় হাতে আর সময় নেই। দ্রুত তা মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে আগামী ১ নভেম্বর শুরু হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে আগামী দিনে রাষ্ট্রগুলো কী পরিমাণ কার্বণ নিঃসরণ কমাবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে। একই সঙ্গে গাবুরার মতো বিশ্বের নানা প্রান্তের জলবায়ু বিপন্ন মানুষের কষ্ট কমাতে কী করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হবে।

গাবুরার দুঃখ

সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা হামিদা খাতুন বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের গবেষকদের কাছে বলছিলেন, এখানকার অধিবাসীদের আইলা–পরবর্তী দুর্দশার কথা। তাঁর অভিজ্ঞতায় জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সমগ্র গাবুরা লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। তখন থেকে খাওয়ার পানির মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট গভীরতায়ও পানির স্তর পাওয়া যায় না। তাঁদের খাওয়ার পানির খোঁজে ছুটতে হয় মাইলের পর মাইল।

গাবুরায় ৩৯ হাজার মানুষের জন্য আছে মাত্র একটি গভীর নলকূপ। অধিকাংশ পরিবার সরাসরি পুকুরের পানি পানের ওপর নির্ভরশীল। নাজমা বেগম বললেন, ঘন ঘন ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। তখন অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

নারীদের প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট। শিশুরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত। হামিদা খাতুন যোগ করেন, যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় তাঁরা চিকিৎসার জন্য জেলা কিংবা উপজেলার হাসপাতালে যেতে পারেন না। বেসরকারি উদ্যোগে স্থানীয় কিছু ক্লিনিক থেকে সেবা নিলেও তা পর্যাপ্ত এবং মানসম্পন্ন নয়।

স্থানীয় এক জেলে সাইদুল গাজী বলছিলেন, আইলার পর ফসলি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ইয়াসে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এসব জমিতে আর ধান চাষ হয় না। লিয়াকত মোল্লা জানালেন, পরপর জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এখন আর গাছপালা ভালো জন্মে না। সবুজ গাছপালা, সুপেয় পানি দিন দিন কমে যাচ্ছে।

গাবুরাসহ উপকূলীয় অনেক জনপদে প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্র অনেক কম। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কৃষিজমিগুলোর বেশির ভাগই এখন ব্যবহৃত হয় কাঁকড়া ও চিংড়ি চাষে।

শূন্যে নামানোর চ্যালেঞ্জ

সারা দেশে তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন অনেকে। এভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বায়ুমণ্ডলে অধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২ দশমিক ৭ কোটি মানুষ ঝুঁকিতে। এ সমস্যা মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী এ শতাব্দীর শেষে প্রাক্‌–শিল্পযুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ নিচে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। প্যারিস চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা (নেট জিরো)৷ আইপিসিসির প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে যে গতিতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা চলতে থাকলে নেট জিরো অর্জন সম্ভব হবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একসঙ্গে বিশ্বের বার্ষিক কার্বন নির্গমনের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনের আগে কার্বণ নিঃসরণ কমানোর নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ দরকার। এ জন্য রাষ্ট্রগুলো নিজ উদ্যোগে কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটি অঙ্গীকারনামা (এনডিসি) জাতিসংঘের কাছে জমা দিয়েছে। এসব দেশের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশ। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ এনডিসি দাখিলে পিছিয়ে রয়েছে। আবার জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো অধিকাংশ দেশ লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করেনি। চীন বলছে, ২০৩০ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ বাড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ৬৮ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যেই নেট জিরো অর্জন না হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন রূপরেখা সম্মেলন (ইউএনএফসিসিসি) বলছে, যেসব দেশ ইতিমধ্যে এনডিসি দাখিল করেছে, তাদের অঙ্গীকার অর্জিত হলেও ২০১০ সালের তুলনায় ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিকভাবে মাত্র ১ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব।

জীবাশ্ম জ্বালানিতে অব্যাহত বিনিয়োগ

বায়ুমণ্ডলে অধিক কার্বন নিঃসরণের জন্য অন্যতম দায়ী অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এমনই একটি উদাহরণ। এর ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে বারবার সতর্ক করেছে ইউনেসকো।

প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যে পরিমাণে কমাতে হবে, বিশ্ব তার চেয়ে ১২০ শতাংশ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পথে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করে চলেছে। জার্মানভিত্তিক পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রুপ আর্জওয়াল্ড বলছে, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক।

তহবিল আসছে না

চলতি বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সম্মেলনের (কপ) সভাপতি অলক শর্মা এ বছরই বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে। আমি নিজ চোখে সুন্দরবনে গিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশের বহু মানুষ সে এলাকায় ঝুঁকিতে বসবাস করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে আছে। তাদের সহায়তা করতে হবে।’ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শর্মাদের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি দরিদ্রতম দেশের জনগণ প্রতিবছর জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় মাথাপিছু মাত্র ১ ডলারের মতো সহায়তা পাচ্ছে! গ্লাসগোতে নতুন তহবিল ঘোষণা করা হচ্ছে না। নতুন বোতলে পুরোনো দাওয়াই পরিবেশিত হবে!

উন্নত দেশগুলো কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে এমন সব সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, যা প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, সম্মেলনের আগেই আয়োজনকারী দেশ যুক্তরাজ্য বিদেশে জলবায়ু সহায়তাকে জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করেছে, উত্তর মহাসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন করে অনুমতি দিয়েছে, বিদ্যুচ্চালিত গাড়িতে প্রণোদনা কমিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় আনার অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কার্যকর পদক্ষেপ দরকার

আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫–এর মধ্যে রাখতে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় পাওয়া যেতে পারে। তারপর পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। উদ্যোগ নিতে হবে শিগগিরই। নতুবা বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হয়েও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সাড়ে ৭ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নতুন করে আসার পর ছয় হাজার একরের বেশি এলাকার বন ধ্বংস হয়েছে। মাটি, পানি, বন, জীববৈচিত্র্য বড় ধরনের হুমকিতে পড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বিশ্ব নেতৃত্বের কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। উত্তরণ এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সম্মেলনে বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশকে অবশ্যই সব নীতি-কৌশলের কেন্দ্রে রাখতে হবে জলবায়ু মোকাবিলার কার্যক্রম। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ আহরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস ত্বরান্বিত না করে টেকসই এবং বজায়ক্ষম আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি উৎপাদনব্যবস্থাকে অবশ্যই টেকসই, সবুজ এবং পরিবেশবান্ধব হতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতিবিধ্বংসী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ-বন, নদ-নদী ইত্যাদি সংরক্ষণ জরুরি। বৈশ্বিক সহযোগিতা, অংশীদারত্ব এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।

  • রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর চেয়ারপারসন। আইইউসিএন এশিয়া আঞ্চলিক মেম্বার্স কমিটির ভাইস চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের আইইউসিএন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন।