বন্যার সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। ইতিমধ্যে বন্যাজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ১০৪-এ পৌঁছেছে। আর বন্যায় আক্রান্ত ২৮টি জেলায় ৫৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোতে ইতিমধ্যে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দৈনিক দুর্যোগ প্রতিবেদন, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবারও জামালপুরে বন্যার পানিতে নৌকা ডুবে পাঁচ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও বগুড়ায় নতুন করে অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি আশপাশের গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় আশপাশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
বন্যা প্রলম্বিত হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ছয়টি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাঙন আরও বাড়বে। পূর্বাভাসের তুলনায় এবার বেশি এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে বলে সরকারি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) মনে করছে।
এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুরোপুরি ও আংশিক ভেঙে গেছে। ৩০৮টি সেতু ও প্রায় ৪৫ হাজার টিউবওয়েল বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের আবাসিক কার্যালয় থেকে গত সোমবার প্রকাশ করা বন্যা পরিস্থিতিবিষয়ক প্রতিবেদনে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কুড়িগ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হওয়ায় রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল আবারও প্লাবিত হতে পারে। এমনকি রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে বন্যার পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। আজ ও আগামীকাল বৃষ্টি হলে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের এলাকা বাড্ডা, গোড়ান, সাতারকুল ও হাতিরঝিলের আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যবর্তী এলাকা ডেমরায়ও বন্যার পানি চলে আসার আশঙ্কা আছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত মনে করেন, এবার ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা অববাহিকায় বন্যার পানি নামতে বেশ সময় লাগতে পারে। কারণ, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় একদফা বন্যার পর এক সপ্তাহের বিরতি দিয়ে আবারও পানি বাড়ছে। আগামী তিন-চার দিন পানি বাড়তে পারে। আর এই পানি পুরোপুরি নামতে আগস্ট মাসের পুরো সময় লেগে যেতে পারে। কারণ, আগস্টেও থেমে থেমে বৃষ্টি হতে পারে। ফলে এসব এলাকার দীর্ঘস্থায়ী বন্যা মোকাবিলায় সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্রুত আক্রান্ত এলাকায় খাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্বল ও ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আগামী এক মাসের জন্য দেওয়া বন্যার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় পানি বাড়ছে। উজানে বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে পানি কিছুটা ধীরে নামতে পারে। সামগ্রিকভাবে চলমান বন্যার চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। চলতি মাসের শেষে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। আর আগস্টের শেষের দিকে দেশে আরেক দফা বন্যা হতে পারে।
>২৮ জেলায় বন্যা
এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৪
আক্রান্ত ৫৩ লাখ মানুষ
নদীভাঙন এবার বাড়তে পারে
সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি বেড়ে আজ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। নীলফামারী ও লালমনিরহাটের পরিস্থিতি একই রকম ও সিলেটে উন্নতির সম্ভাবনা আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ থেমে থেমে বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা আছে। এরই মধ্যে গত বুধবার থেকে সারা দেশে কমবেশি বৃষ্টি বেড়েছে। গতকাল টেকনাফে দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে, ১২৪ মিলিমিটার। রাজধানীতে হয়েছে ১২ মিলিমিটার। এই বৃষ্টিপাত আরও তিন দিন চলতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের যে বন্যাটি এখন চলছে, তার বিস্তৃতি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। বিশেষ করে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় মানুষের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। এই বন্যার আরেকটি দিক হচ্ছে, এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও জলাবদ্ধতা কিন্তু থেকে যেতে পারে।
ভাঙন বাড়তে পারে
গত এপ্রিলে সিইজিআইএসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর দেশের ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর বা ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারাতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভাঙনের মুখে পড়তে পারে পদ্মাপারের মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার নদীতীরবর্তী এলাকা। সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা চলমান বন্যা পরিস্থিতি ও নদীভাঙন পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, এবার ভাঙনের পরিমাণ পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি হবে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও বগুড়ায় ভাঙন বেশি হবে।
দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে এ ভাঙন প্রবল হতে পারে। এসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় ভাঙনের ঝুঁকিও বেশি।
কোথায় কত মৃত্যু
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাজনিত কারণে এ পর্যন্ত ১০৪ জন মারা গেছে, বেশির ভাগই শিশু। প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে জামালপুরে, ৩৪ জন; এরপর যথাক্রমে গাইবান্ধায় ১৯ ও নেত্রকোনায় ১৬ জন। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। একই সময়ে পদ্মা, যমুনা ও গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ৫৮১ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি জেগে উঠেছে।
জানতে চাইলে সিইজিআইএসের উপনির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এবার বন্যা ধারণার চেয়ে বেশি সময় ধরে চলছে। ফলে ভাঙন বেশি হতে পারে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার জেলাগুলো বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।