পানি সরে গেছে, জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। তবে কোথাও ফসলের চিহ্ন নেই। পাট, ধান, সবজি—সব পচে গেছে। দুই মাস বন্যায় তলিয়ে থাকা বগুড়ার সারিয়াকান্দির দুর্গম হাটবাড়ি চরে সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেল এ চিত্র।
সারিয়াকান্দি শহরের কালীতলা খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে হাটবাড়ি চরে পৌঁছাতে। চরের তিন দিকে জামালপুরের ইসলামপুর ও মাদারগঞ্জ এবং গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা। এখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের বাস। বেশির ভাগেরই জীবিকা চলে যমুনা নদীতে মাছ ধরে। বাকিরা প্রান্তিক কৃষক ও দিনমজুর।
চরের কিনারে দেখা হলো ৭৫ বছর বয়সী ফজলু শেখের সঙ্গে। বললেন, বন্যার সঙ্গে এবার ভাঙনের যে তাণ্ডব ছিল, তাতে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে চরবাসীর। বসতবাড়ি, ফসল হারিয়ে তাঁরা এখন নিঃস্ব।
চরের কয়েকজন জানালেন, এই সময়ে চরের সবখানে জাগ দেওয়া পাটের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাট ঘরে তোলার আনন্দে কৃষকের চোখেমুখে থাকে খুশির ঝিলিক। অথচ এবার বন্যা ও নদীভাঙনে বসতবাড়ি, ফসল হারিয়ে সবাই দিশেহারা। শুধু হাটবাড়ি নয়, কোমর ভেঙে গেছে সারিয়াকান্দির চরাঞ্চলের প্রায় সবার।
পচে গেছে মরিচ, ভেসে গেছে পাট
চরের প্রধান ফসল মরিচ। এই ফসলেই বছরের ছয় মাসের খরচ ঘরে ওঠে কৃষকের। দূরদূরান্তের পাইকারেরা এসে মরিচ কেনেন। নদীতীরবর্তী হাটে মরিচ কেনাবেচা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের মুখে এবার তিন মাস হাট বসেনি। পাইকারেরও দেখা মেলেনি। খেতের মরিচ খেতেই পচেছে। মরিচে লোকসান পাটে পোষানোর আশা ছিল। বন্যায় নদীতে ভেসে গেছে সে স্বপ্নও।
খাটিয়ামারি চরের জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চরত পত্তা (মরিচ) চাষে ম্যালা প্যাকনা। এক বিঘা পত্তার চাষ করবার যায়্যা খরচ ২০ হাজার টেকা। দুই হাজার টেকাও তুলবার পারিনি। তিন মাস হাট লাগেনি। ব্যাপারীও পত্তা কিনবার আসেনি। ব্যাচপার না পারে খ্যাতের পত্তা খ্যাততই লষ্ট হচে।’
হাটবাড়ি চরের গণি সরকার ধারদেনা করে সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। করোনার সংক্রমণে হাট বন্ধ থাকায় কষ্ট করে শহর থেকে বীজ সংগ্রহ করে হালচাষ থেকে বোনা পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে তাঁর। স্বপ্ন ছিল পাট বিক্রি করে কোরবানির ঈদে দুটো হালের বলদ কিনবেন। কিন্তু বর্ষার আগেই ভাঙনে পাটসহ তাঁর সাত বিঘা জমি বিলীন হয়ে গেছে।
গণি সরকার বলেন, ‘জমিনত পাটখ্যাত আচল। খ্যাতের পাট সব বানত ডুবে গেচে। ১০ বিঘা আবাদি জমিনটাও যমুনা খায়্যা ফালাল।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলাতেই বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার ওপরে। বিনষ্ট হয়েছে ৬ হাজার ২৩৭ হেক্টর জমির পাট, আউশ, আমনের বীজতলা, শাকসবজিসহ নানা জাতের ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৭৮০।
জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। তবে কোথাও ফসলের চিহ্ন নেই। পাট, ধান, সবজি পচে গেছে।
কষ্টে জেলে-দিনমজুরেরা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকেই হাতে কাজ নেই। রোজগার নেই। ঘরে খাবার মজুত নেই। পাঁচ মাস ধরে কোনোরকমে অর্ধাহারে দিন কাটছিল চরবাসীর। এর মধ্যেই বন্যার ধাক্কা। ভাঙনে বিলীন অনেকের বসতঘর, জমি। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন জেলে, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষ।
হাটবাড়ি চরের নজরুল শেখ যমুনায় মাছ ধরে সংসার চালান। বললেন, ‘মাছ না জুটলে বউ-ছলের মুখত ভাত জোটে না। ভাইরাসের ভয়ে তিন মাস গঞ্জত যাওয়া বন্ধ। লদীত মাছ ধরবারও পারিনি। হাতত কাম নাই। ঘরত ভাত নাই। ছলপল লিয়্যা খুব কষ্টে দিন চলিচ্চে।’
দলিকার চরের দিনমজুর লাল মিয়ার বসতঘরে ছিল কোমরপানি। তিনি বললেন, ‘খুব কষ্টে আচি। হাতত কাজ নাই। কামাই-রোজগার নাই। খাবারের কষ্ট। কামলা জোটে না। সংসারত চারডা মানুষ। ইংকা কষ্ট সহ্য করবার পারিচ্চি না।’
নৌকার ওপর বাল্যবিবাহের প্যান্ডেল
চরে পৌঁছেই দেখা পাওয়া ফজলু শেখের পিছু নিয়ে লোকালয়ে যাই। তখন বন্যার সময়। কিছুদূর এগোতেই কানে ভেসে আসে গানের আওয়াজ। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল পানিতে থই থই বাড়ির উঠান, বারান্দা। সেখানে কয়েকটি ডিঙি একসঙ্গে বাঁধা। তার ওপর রঙিন শামিয়ানা টাঙানো। এটা আসলে বিয়ের প্যান্ডেল। পাশে উঁচু জায়গায় চলছে রান্নার আয়োজন।
প্যান্ডেলের পাশের একটি ঘরে বুকসমান পানি। সেখানে চলছিল কনে সাজানোর কাজ। নারীরা দল বেঁধে গাইছেন গীত। বরকে বরণ করতে ডালা সাজিয়ে প্রস্তুত। একটু পরই বরযাত্রীর নৌকা ভিড়ল। বর বরণে ব্যতিব্যস্ত কনেপক্ষের লোকজন। আনুষ্ঠানিকতা সেরে পড়ন্ত বেলায় ১৩ বছরের কনেকে নিয়ে ছেড়ে গেল বরযাত্রীদের নৌকা।
একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, অন্যদিকে বন্যার হানা। এর মধ্যেই ঘটা করে বাল্যবিবাহের এ আয়োজনে বিস্ময় ও কৌতূহল জাগে। তবে চরের বাসিন্দারা জানালেন, এখানে বাল্যবিবাহের এমন আয়োজন নিত্যঘটনা। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না-পেরোতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়।
চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, এসব চরে কোনোরকমে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। আশপাশে কোথাও মাধ্যমিক স্কুল নেই। নৌকায় তিন-চার ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এত দূরে মেয়েদের পাঠাতে সাহস পান না বাবা-মায়েরা।
সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ি ও বহাইল ইউনিয়নের ৩৮টি চর ঘুরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। বাল্যবিবাহ নিয়ে তাঁরা প্রায় সবাই ইউপি সদস্য খোরশেদ আলমের কথারই প্রতিধ্বনি করেন।
নেই প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা, মৃত্যুঝুঁকিতে কিশোরীরা
দলিকার চরের লাল মিয়া ২০ বছর বয়সে বিয়ে করেন ১২ বছরের পারুল আকতারকে। দুটি কন্যাসন্তানের পর তৃতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান পারুল।
চরের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘দুর্গম এ চরের আশপাশত হাসপাতাল নাই। খেয়া লৌকা নাই। গত ২০ বছরে ছল হবার যায়্যা ১০-১৫ জন পোয়াতি মারা গেচে। সগলিরই অল্প বয়সে বিয়া হচিল।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সারিয়াকান্দির কোনো চরেই ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। ১০টি চরে কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছিল। এবারের বন্যা ও ভাঙনে পাকুরিয়া, উত্তরশিমুলতাইড় ও বহুলাডাঙ্গা চরের তিনটি ক্লিনিক বিলীন হয়েছে। বাকি সাতটি ক্লিনিকেও ওষুধ নেই, সেবাও নেই তেমন। স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতায়াত করেন অনিয়মিত।
নেই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী
সুজনেরপাড়া চরের মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগমের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। আট বছরের সংসারজীবনে চার ছেলেমেয়ের মা তিনি। আঞ্জুয়ারা বলেন, ‘চরত বেলুন-বড়ি এগলা হামরা কুন্টি পামো? বেলুনওয়ালা আফারাও চরত আসেন না। আল্লা ছল দিলে হামি কী করমো, কন?’
দলিকার চরের নুরজাহান বেগম ১২ বছর বয়সে বউ হয়ে আসেন আজিজার রহমানের ঘরে। এখন তিন মেয়ে ও এক ছেলের মা তিনি। নুরজাহান বলেন, ‘বড়ি খালে ছল লেওয়া বন্ধ হয়, সেডা হামাগরক কেউ কয়নি। চরত বড়িও পাওয়া যায় না।’
চালুয়াবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, চরের অধিকাংশ দম্পতি চার থেকে আটটি পর্যন্ত সন্তান নেন। চরাঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তেমন ভূমিকা নেই।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, অধিক সন্তান নেওয়ার জন্য দায়ী শিক্ষার অভাব, অসচেতনতা, আর্থসামাজিক অবস্থাসহ নানা কারণ। তাই শুধু পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ওপর দায় চাপানো ঠিক হবে না।