গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবনের বাইরে পার্বত্যাঞ্চলের রাঙামাটির বাঘাইছড়ির কাসালং বনে ১০টি বাঘ থাকতে পারে।
দেশের পার্বত্য এলাকায় একসময় বাঘের বিচরণ ছিল, এমনকি চট্টগ্রামের গহিন বনাঞ্চলেও বাঘের অস্তিত্ব থাকার কথা বিভিন্ন সময়ে বন্য প্রাণী গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন। একসময় বাঘের অস্তিত্ব থাকার কারণেই চট্টগ্রাম শহরে ‘টাইগারপাস’ নামে একটি এলাকার নামকরণ হয়েছে, এমন কথাও প্রচলিত আছে। তবে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে বাঘ বহু বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু দেশের সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ টিকে আছে। এর মধ্যে নতুন তথ্য হলো দেশের বাঘ গবেষকেরা নিশ্চিত করেছেন, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার কাসালং বনে এখনো বাঘ আছে। ওই এলাকায় বাঘের বসতি উপযোগী পরিবেশ এবং খাদ্য আছে। ঠিকমতো সংরক্ষণ করা গেলে সুন্দরবনের পরে ওই এলাকা হতে পারে বাঘের দ্বিতীয় বসতি অঞ্চল।
গত ২৩ জুলাই কাসালং সংরক্ষিত বনে বাঘের খোঁজে গিয়েছিল বাঘ ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের একটি দল। বন অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার (আইইউসিএন) সমন্বয়ে গঠিত দলটির নেতৃত্ব দেন বাঘ বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দুই অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান ও আবদুল আজিজ। আইইউসিএনের এদেশীয় প্রতিনিধি (কান্ট্রি ডিরেক্টর) রাকিবুল আমিন ও সংস্থাটির প্রধান বিজ্ঞানী এ বি এম সারোয়ার আলমসহ মোট ১৪ জন ওই দলটিতে ছিলেন। তাঁরা এলাকায় বাঘের অস্তিত্ব থাকার কিছু প্রমাণ পেয়েছেন। এ ছাড়া কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে পেয়েছেন, যাঁরা মাসখানেক আগেও কাসালং নদ পাড়ি দিচ্ছে বাঘ, এমন দৃশ্য দেখেছেন।
শুধু তাই নয়, বাঘের খাবার হিসেবে যেসব প্রাণী রয়েছে, তার বড় অংশ ওই বনভূমিতে রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকেরা। মোট চার দিনের মাঠ গবেষণা বা অভিযানে গবেষক দলটি বাঘের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়ার পাশাপাশি ওই বনে হাতি, ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাঁচ প্রজাতির সরীসৃপজাতীয় প্রাণী, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী ও ৪৪ প্রজাতির প্রজাপতি খুঁজে পেয়েছেন।
খুঁজে পাওয়া বন্য প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গোল্ডেন ক্রেস্টেড ময়না’। এই পাখি এই প্রথম বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এর আগে এটি ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে একবার শুধু দেখা গিয়েছিল। পাহাড়ি ময়নার চেয়ে এটি আকৃতিতে কিছুটা ছোট এবং মাথার গড়ন ভিন্ন। ‘স্ট্রেইট পাইরট’ নামের একটি প্রজাপতিও এই প্রথম ওই বনভূমিতে দেখা গেছে। এর আগে এটি ভারতে আছে বলে মনে করা হতো। এ ধরনের প্রজাপতি বাংলাদেশে ছিল না বলে এত দিন ভাবা হতো।
গতকাল শনিবার বন অধিদপ্তর এবং আইইউসিএন যৌথভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া এবং অন্যান্য বন্য প্রাণী নিয়ে একটি ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেখানে দেশের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। তাঁরা কাসালং সংরক্ষিত বনের দুর্গম বনভূমিতে বাঘের জন্য উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেন।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বাঘ সংরক্ষণের জন্য যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। এ গবেষণার মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন কাজ হবে বাঘ যাতে সেখানে টিকে থাকে, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা।
এর আগে ২০০৯ সালে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান পার্বত্য এলাকায় বাঘের খোঁজ পান। তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের ঘরে বেঙ্গল টাইগারের শরীরের বিভিন্ন অংশ সংরক্ষণের প্রমাণ পান। একই সঙ্গে স্থানীয় এক অধিবাসীর কাছে বাঘের মাথার খুলি পান। ২০১০ সালে তিনি তাঁর এক বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০টি বাঘ টিকে ছিল বলে উল্লেখ করেন।
পরবর্তী সময়ে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স নামের একটি বন্য প্রাণিবিষয়ক সংস্থা থেকেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে পায়। গত জুন মাসে কাসালং সীমান্তবর্তী ভারতের মিজোরাম এলাকার বনভূমিতে দেশটির বন বিভাগের ক্যামেরায় বাঘের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এর থেকে বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম মিলিয়ে বাঘের একটি বসতি আছে।
মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১০ সালে আমার কাছে মনে হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে ২০টি বাঘ আছে। এখন তা অবশ্যই ১০–এর নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে কাসালং এলাকাটিকে যদি আমরা বাঘের জন্য সংরক্ষিত এলাকা এবং সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করতে পারি তাহলে সেখানে বাঘ টিকিয়ে রেখে এর সংখ্যাও বাড়ানো সম্ভব।’