কর্ণফুলীতে দিনে পাঁচ হাজার টন বর্জ্য

রাজাখালী খাল থেকে কালো পানি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। নগরের বর্জ্যমিশ্রিত পানির পাশাপাশি পলিথিন ও নানা অপচনশীল প্লাস্টিক সামগ্রীও যায় নদীতে। গত রোববার দুপুরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ
রাজাখালী খাল থেকে কালো পানি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। নগরের বর্জ্যমিশ্রিত পানির পাশাপাশি পলিথিন ও নানা অপচনশীল প্লাস্টিক সামগ্রীও যায় নদীতে। গত রোববার দুপুরে  চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ

দিনে পাঁচ হাজার টন পয়ো ও গৃহস্থালির বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। পাশাপাশি রয়েছে শিল্প ও চিকিৎসা বর্জ্য। এর বাইরে নদীতে চলাচলকারী নৌযানগুলোর পোড়া তেলে কর্ণফুলীর দূষণ চরমে পৌঁছেছে। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার নদীসংলগ্ন খালগুলো।

দূষণের কারণে স্বাস্থ্যগত, জলজ, অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষতির কথা ‘চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণ রোধ, নাব্যতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ দখল রোধকল্পে প্রণীত খসড়া মহাপরিকল্পনা’য় উল্লেখ করা হয়েছে।

কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম), সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, সিইউএফএলের মতো সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানই কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য মূলত দায়ী।

সরেজমিন চিত্র
গত বুধবার কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত রাজাখালী খালের মুখে গিয়ে দেখা যায়, কালো রঙের তেল গিয়ে পড়ছে নদীতে। নদীর মুখে তখন দুটি ধারা। একটি কালো, অন্যটি নদীর বালুমিশ্রিত ঘোলাটে ধারা। 

পাশের চাক্তাই খালের মুখেও একই চিত্র চোখে পড়ে। খাল থেকে গৃহস্থালি এবং পয়োবর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি গিয়ে মিশে যাচ্ছে নদীতে। সঙ্গে রয়েছে পলিথিন, প্লাস্টিক এবং নানা অপচনশীল সামগ্রী। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় গবেষণাগারের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন, নদীর সংযুক্ত খালগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। এটা আমাদের নিয়মিত নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়। তবে জোয়ার ভাটা আছে বলে অন্যান্য অনেক নদীর চেয়ে এখনো কর্ণফুলী ভালো রয়েছে।

দূষণের কারণ
সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণ রোধ, নাব্যতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ দখল রোধকল্পে প্রণীত খসড়া মহাপরিকল্পনা করেছে সরকার। এতে কর্ণফুলী দূষণের জন্য কেপিএম, পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, সার ও কীটনাশক, পোলট্রি বর্জ্য ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়।

মহাপরিকল্পনায় বলা হয়, মহানগরে ৫০ হাজার স্যানিটারি এবং ২৪ হাজার কাঁচা শৌচাগার রয়েছে। এ ছাড়া ১১টি উপজেলার গরু–ছাগল এবং হাঁস–মুরগির খামারের বর্জ্য নদীতে মেশে। ওয়াসার কোনো সুয়ারেজ সিস্টেম না থাকায় সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।

বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, প্রতিদিন আড়াই হাজার টন তরল বর্জ্য গিয়ে নদীতে পড়ছে। সুয়ারেজ নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা হয়েছে। নগরকে ছয় ভাগে ভাগ করে সুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

প্রায় ৭০ লাখ লোকের এই নগরে দিনে আড়াই হাজার টন গৃহস্থালির বর্জ্য তৈরি হয়। এর কমবেশি নালা নর্দমা হয়ে গিয়ে পড়ে নদীতে। তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা সফিকুল মান্নান সিদ্দিকী দাবি করেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহের কারণে নদীতে বেশি বর্জ্য যাওয়ার সুযোগ কম।

ইটিপি কার্যকর রাখে না
তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম নগর এলাকার ৮৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলার বর্জ্য নিঃসরণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ইটিপি রয়েছে।

তবে ইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না রাখার অভিযোগ রয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।

এদিকে, ত্রুটিপূর্ণ ইটিপি ব্যবস্থার জন্য গত মাসে কেডিএস ওয়াশিং এবং সানজি টেক্সটাইলকে জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, অনেকে ইটিপি থাকলেও তা চালু রাখে না। এ জন্য জরিমানা করা হয়।

প্রভাব
প্রতি মাসে নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। শুষ্ক মৌসুমে পরীক্ষায় দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৫ এর মধ্যে থাকে যা উদ্বেগজনক। পানিতে ডিওয়ের মান ৪–এর নিচে নামলে তা পানিতে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যর জন্য হুমকিস্বরূপ। কর্ণফুলী গবেষক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, ডিও ৪–এর নিচে নেমে এলে জলজ প্রাণী বাঁচে না।