সাখওয়াত হাবীব প্রায় দেড় দশক ধরে আম চাষে যুক্ত। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার গোবিন্দভিটা গ্রামে তাঁর বাড়ি। এ বছর ৪৮৩ বিঘা জমিতে আমের চাষ করেছেন। নিজের জমি ৫৩ বিঘা, বাকিটা বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিতে নেওয়া। গেলবারের তুলনায় এবার আমগাছে মুকুল এসেছিল বেশি। সাখওয়াত এবার ভালো ফলন আশা করেছিলেন। গাছে এখন ফলও যথেষ্ট আছে। আমের এই বৃহৎ কারবারি বলছিলেন, ‘এবার আম আকারে ছোটও হতে পারে। ফলে কেজির হিসাবে উৎপাদন কম হতে পারে। তারপরও গতবারের চেয়ে ভালো ফলন আশা করছি। জানি না কী হবে।’
সপ্তাহখানেক আগে অনেক দিন পর ভালো বৃষ্টি হয়েছে নওগাঁ, রাজশাহীসহ উত্তরের আমরাজ্যে।
আমের কথা উঠলেই আমরা রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে নিয়েই ভাবি। কিন্তু গত এক দশকে সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দেশের উত্তরের এই দুই জেলাকে ছাড়িয়ে এখন এগিয়ে উত্তরের আরেক জনপদ নওগাঁ। এ জেলার শুকনা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পোরশা, পত্নীতলা, সাপাহার, নিয়ামতপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন আমের রাজত্ব। এ রাজত্বের পরিধি দিন দিন বাড়ছে।
প্রচণ্ড গরম কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টদেরও চিন্তায় ফেলেছিল। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নওগাঁর উপপরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ সোমবারের বৃষ্টিতে চিন্তামুক্ত অনেকটা। গেল বছর জেলার ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮৫ হাজার টন আম হয়েছিল। এবার চাষের জমি বেড়েছে খানিকটা। লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ১০ হাজার টন। কারণ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে নওগাঁর হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় সাড়ে সাত মেট্রিক টন, রাজশাহীতে ১১–এর কিছু বেশি। সেখানে নওগাঁয় তা ১২ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায়।
নওগাঁর সরকারি কৃষি দপ্তরের ধারণা, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার বেশি আম হবে। কর্মকর্তা শামছুল ওয়াদুদ প্রচলিত একটি প্রবচনও শোনালেন, ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান।’ অর্থাৎ, ধান ভালো হলে আমের ফলন ভালো হয়। আর তেঁতুল বেশি হলে বন্যা হয়।
কৃষিবিদ ওয়াদুদ বলছিলেন, এ বছর এ অঞ্চলে ধান ভালো হয়েছে। আমও ভালো হবে।
এ আশা নওগাঁ পেরিয়ে আমের আরেক বড় রাজত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জেও রয়েছে। জেলায় এবার গতবারের চেয়ে ভালো ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগ আশা করছে, এবার ২ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন আম হবে। গত বছরের চেয়ে যা প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিক টন বেশি। চাষের এলাকাও গত বছরের চেয়ে প্রায় হাজার হেক্টর বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্তি উপপরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মাওলা বললেন, ‘এবার ৯৪ শতাংশ মুকুল ছিল। কমবৃষ্টিতে ফলের আকার ছোট হতে পারে, কিন্তু উৎপাদন এবার ভালোই হবে। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ফসলের বেশ লাভ হয়েছে।’
জেলার গোমস্তপুর উপজেলার রাজারামপুরের আমচাষি রফিকুল ইসলাম ৩০০ বিঘায় আমের চাষ করেছেন। গতবারের চেয়ে এবার অনেক ভালো ফলন হয়েছে। কারণ, এই জেলার আম পাকে বেশ দেরিতে। সময়টা এখনো বেশ খানিকটা বাকি। গতবার করোনা আবহে ব্যবসায় খুব খারাপ হয়নি। এবার আরও ভালো আশা করছেন। তবে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁদের গাছে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই, তাঁরা সমস্যায় পড়তে পারেন। কিন্তু আমি যথেষ্ট সেচ দিতে পেরেছি। ফলনও খুব ভালো হয়েছে। এবার বাম্পার ফলন হবে।’
রফিকুলের এই কৃষিজ্ঞানে সায় মিলল বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যেও। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এম এ রহিম বললেন, সেচ ভালো না হলে ফলের আকার ছোট হতে পারে। কিন্তু পানি যদি ভালো করে দেওয়া হয় আর এ খরা চলে, তবে আমে বরং রোগবালাই কম হবে। মাছি পোকা, ভোমরা পোকা ও হোপার পোকা আমের শত্রু। অধ্যাপক রহিমের কথা, সেচের সঙ্গে গরম হাওয়ায় এসব পোকা কমবে আবার সেই সঙ্গে কম হবে ফোসকা রোগও। এখন বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকার জন্য এসব পোকা ও রোগের আধিক্য কমবে। বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়লে এসব পোকা বাড়ে।
রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়ালয়ের তথ্য, এবার মাছি পোকার সংক্রমণ প্রায় নেই। নিজ জেলা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ অভিজ্ঞতা জানালেন এ কৃষিবিদ। তাঁর কথা, বৃষ্টির স্বল্পতা এ অঞ্চলে আমের ফলনে বাধা হবে না।
সমতলের পানির সংকট থাকলে সেচ দিয়ে তা পূরণ সম্ভব। গরম হাওয়া আর পানির পর্যাপ্ত সেচ—এ দুয়ের কারণে ফলের রাজার আগমন বর্ণাঢ্য হয়, কৃষি বিশেষজ্ঞদের কথায় তা স্পষ্ট। কিন্তু দূর পাহাড়ে, যেখানে সেচের উন্নত ব্যবস্থা নেই, সেখানে কিন্তু পরিস্থিতি এমন সুখকর নয়।
অধুনা আমের স্থান হিসেবে তিন পার্বত্য জেলা নিজেদের জাহির করতে শুরু করেছে। তিন জেলার মধ্যে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি মিলিয়ে ছয় হাজার হেক্টেরের বেশি জমিতে আমের ফলন হচ্ছে। আর শুধু বান্দরবানেই চাষ হচ্ছে সাত হাজার হেক্টেরের বেশি জমিতে। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক এ কে এম নাজমুল হক বলছিলেন, পাহাড়ে কম বৃষ্টির ফলে এবার ফল ঝরে গেছে ইতিমধ্যে। এখানে তো সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা নেই। এবার ফলন অন্তত ৩০ শতাংশ কম হবে। বাকি দুই জেলার একাধিক কৃষক ও কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টদেরও একই কথা।
সারা দেশে এবার লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে জানতে গেলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং এবং হর্টিকালচার উইং কোথাও সুনির্দিষ্ট উপাত্ত মেলেনি। অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর ২৪ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আম উৎপাদিত হয়েছিল। আট বছরের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এবার ফলন বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।