আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস

আমাদের দুর্যোগ, তাঁহাদের ব্যবস্থাপনা

১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে জনগণ ও সরকারের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই এ উদ্যোগ।

মাত্র চার মিনিটের ঝড়ে বিধ্বস্ত বসতবাড়ি। এ বছরের জুলাই মাসে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের মুথরেশপুর ইউনিয়নের হাড়দ্দাহ গ্রামে
ফাইল ছবি

নানা দিবসের ঘনঘটায় আমাদের দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার সয়লাব। কোনো কোনো দিন একাধিক দিবস পালনের ডাক থাকে। বেশির ভাগ দিবসই আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব, কাজেই আমজনতার আগ্রহ কম। আয়োজক আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া কাউকেই ধারেকাছে পাওয়া যায় না। শতরঞ্জির মালিক বা ডেকোরেটরের লোকজন অবশ্য শেষ পর্যন্ত থাকেন নিজেদের গরজে। তবে নতুন নতুন জনগুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলো বছরের বিশেষ এক দিনে তাদের করণীয়গুলো বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ কয়েকটা দিনকে বেছে নিয়েছে। অক্টোবরের ১৩ তারিখ (আজ) যেমন আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এই দিন দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে উৎসাহিত ও প্রবল করার জন্য চেষ্টা করা হয়। সেই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে (ঝুঁকি কমিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে) জনগণের অর্জনসমূহ চিহ্নিত করা ও সেগুলোকে উৎসাহিত এবং উদ্‌যাপনের ব্যবস্থা করা হয়।

দিনক্ষণ ঠিক করে উদ্‌যাপনের রেওয়াজ পৃথিবীর নানা সভ্যতার মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আজকাল হুজুগে অনেক দিবসের লম্বা লাইন পড়ে গেলেও কাজের দিবসগুলো ঠিকই টিকে আছে। যেমন টিকে আছে চৈত্রসংক্রান্তি, পূজা–অর্চনা যা কিছু তার অনুষঙ্গ হিসেবে জুটুক না কেন আসল চর্চাটা ছিল চৈত্র বা বছরের শেষে প্রকৃতি আর পরিবেশের হালনাগাদ অবস্থা যাচাই করা। দিনটি ছিল নিরামিষ দিন। নিরামিষ রান্না হতো বাড়ি বা ভিটের আশপাশ থেকে কুড়িয়ে আনা আনাজ আর শাকসবজি দিয়ে। কৃষির বাইরে গজিয়ে ওঠা ফল–ফসলের ভিটা জরিপ ছিল সেটা। কোনটা হারালাম, নতুন কিছু গজাল কি না, সেটা জানা হয়ে যেত ভিটেতে পাওয়া শাকপাতা দিয়ে তৈরি নিরামিষ পদ থেকে। আমরা আজ সংক্রান্তিকে ধর্মের আর আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে মুড়িয়ে আসল উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। আধুনিক দিবসগুলোর যেন একই পরিণতি না হয়।

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন দিবস

আশির দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্যোগের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পর ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দুর্যোগের ঝুঁকির বাড়বাড়ন্ত অবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যেহেতু নানা কারণে দিন দিন দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, তাই ত্রাণ ও উদ্ধারের মতো কাজের চাপ কমাতে এবং মানুষের জীবন আর সম্পদের সুরক্ষার জন্য দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে ফেলতে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।

ঝুঁকি হ্রাসের খরচ কম। সেই মোতাবেক ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর শরৎকালে (অক্টোবরের ১৩ তারিখে) সারা বিশ্বে এই দিবস উদ্‌যাপিত হয়। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে জনগণ ও সদস্যরাষ্ট্রের সরকারদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই এ উদ্যোগ।

দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস নিয়ে আলোচনা আর নীতিনির্ধারণের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে জাপানের সান্দাই শহরে ২০১৫ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশ বসেছিল। সেই সমাবেশে দুর্যোগের ঘনঘটায় বিনিয়োগের আর টেকসই উন্নয়ন যে মহা হুমকির মধ্যে আছে, সেটা অনুধাবন করে বেশ খোলাখুলি আলোচনা হয়। ঠিক হয় দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য আরও জানমন দিয়ে কাজ করতে হবে। সান্দাই সমাবেশে জাপানের উদ্যোগে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের একটা দিকনির্দেশনামূলক ছক পেশ করা হয়। সেটাই এখন সর্বজন গৃহীত ‘সান্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’। জাপানিরা যেমন বোলচাল গপশপের চেয়ে কাজকে বেশি সময় দেয়, তাই ‘সান্দাই ফ্রেমওয়ার্ক’ এ কাজের কথাই বেশি বলা হয়েছে। বলা হয়েছে গণমানুষের সম্পৃক্ততার কথা। প্রতিবছর এ ক্ষেত্রে সদস্যরাষ্ট্রের অগ্রগতির একটা সালতামামি পেশ করার জন্য সবাই একমত হন। সবাই মিলে ঠিক করেন ২০৩০ সালের মধ্যে সাতটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাবেন।

এই সাতটি লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে ১. জীবনহানিকে যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলা। ২. দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা। ৩. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখা ৪. অবকাঠামো সচল রাখা ৫. ঝুঁকি হ্রাসে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হাসিল করা ৬. ঝুঁকি হ্রাসের সব তথ্য মানুষের নাগালে থাকবে এবং ৭. ২০২০ সালের মধ্যে সব সদস্যরাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের কৌশল ঠিক করতে হবে। বলা বাহুল্য, এটা শুধু কাগজে–কলমের বিষয় নয়, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের কৌশলপত্রটা হবে একটা জীবন্ত দলিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এই দলিলের ভিত্তিতেই ঠিক হবে কোন কাজটি করলে জনমানুষ, অবকাঠামো, অর্থনীতি, জীবন–জীবিকা বিপন্ন হবে না। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দেবে না। আরও খোলাসা করে বলতে গেলে তথাকথিত উন্নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপের আগে যাচাই করে দেখতে হবে সেটি আমাদের দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কি না। গুলিস্তান থেকে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন পর্যন্ত এক গাড়িতে একদমে পৌঁছানোর জেদকে আমরা পাত্তা দেব, নাকি হাওরের জীবন–জীবিকা আর ভূমিজলের টেকসই বিকাশকে আমলে নেব। ঝুঁকি হ্রাসের কৌশলকে পাশ কাটিয়ে নদী, হাওর, উপকূল, সুন্দরবন, মধুপুর, পাহাড় বা সাগরে কোথাও কোনো অবকাঠামো নির্মাণ বা উৎপাটন করা যাবে না।

আমাদের অভিজ্ঞতা

অতীতে আগাপাছতলা না ভেবে কথিত উন্নয়নের বড়ি খেয়ে আমরা জেনে বা না জেনে অনেক দুর্যোগের জন্ম দিয়েছি। ঝুঁকি তৈরি করেছি বড় বড় দুর্যোগের। দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সর্বনাশা জলাবদ্ধতা এসেছে পোলডার আর রিং বাঁধের হাত ধরে। এখন শুধু জলাবদ্ধতা নয়, সেই প্লাবনভূমিতে চিংড়ি চাষের হাত ধরে ভর করেছে চরম লবণাক্ততা। তাই ঘূর্ণিঝড় ওডিশার বিশাখাপট্টনম পর্যন্ত আসতে না আসতে ভেঙে পড়ে বেতকাশির বাঁধ। ম্যালেরিয়া দূর করার জন্য সারা দেশে যথেচ্ছ ডিডিটি ছড়িয়ে নির্বিচার মশার সঙ্গে সঙ্গে ফসলবন্ধু পোকা ধ্বংস করে কীটনাশকের হাতে বন্দী হয়েছি। ক্যানসারকে দিয়েছি খোলা লাইসেন্স।

নিরাপদ পানির গল্প শুনিয়ে নলকূপে নলকূপে সারা দেশ সয়লাব করে দিয়ে আমরা এখন আর্সেনিকের বিষে হাবুডুবু খাচ্ছি। আয়োডিন যে থাইরয়েডে আক্রান্তদের জন্য বিষ, সেটা জেনেও তাদের জন্য কোনো বিকল্প না রেখেই আমরা সব লবণের সঙ্গে আয়োডিন মিশিয়ে গলগন্ড প্রতিহতের চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছি।

দ্রুত বর্ধনশীল গাছের নামে ইপিল ইপিল, একাশিয়া, চম্বল, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি বিদেশি গাছ লাগিয়ে শুধু যে দেশি টেকসই গাছের বারোটা বাজিয়েছি তা–ই নয়, বরং ঝড়ে মানুষের মৃত্যুর হারও বাড়িয়েছি। গত ১০ বছরে ঝড়ে যত মানুষ মারা গেছেন, তার ৮০ ভাগই এসব গাছের নিচে চাপা পড়ে। একাশিয়ার হাত ধরে এ দেশে শক্ত খুঁটি গেড়েছে শ্বাসকষ্ট, বিশেষ করে শিশুদের শ্বাসকষ্ট। ‘সান্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ কথিত উন্নয়নের এসব পরিণতির কথা মাথায় রেখেই জাতীয় ও স্থানীয় পর্যয়ে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের কৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

সবার আগে শাসনব্যবস্থা

নীতি, ঐকমত্য, সমঝোতা এসবেরই কার্যকারিতা নির্ভর করে নির্দিষ্ট দেশটা চলছে কীভাবে, মানে তার গভর্ন্যান্স সিস্টেমের ওপর। তাই সাত লক্ষ্যের সঙ্গে চারটি অগ্রাধিকারের কথাও বলা হয়েছে ‘সান্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’–এ। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রটা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার শাসন তথা গভর্ন্যান্সকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অগ্রাধিকারের তাগিদ দেওয়া হয়েছে ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আর আগের চেয়ে মজবুত করে স্থাপনা তৈরির জন্য। দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গভর্ন্যান্সের ঘাটতি থাকলে যে কী ফলাফল হতে পারে, তা সদ্য সম্প্রতি গৃহায়ণ প্রকল্পে দেখেছি। গত বছর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সুশাসন, নিশ্চিত করবে টেকসই উন্নয়ন’। এসব বিষয় নিয়ে আমরা রচনা প্রতিযোগিতায় যত সময় ব্যয় করেছি, তার সিকি সময় দিয়ে প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে যদি নির্বাহী কর্মকর্তাদের হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করা হতো, তাহলে আজ চোর খুঁজতে ঢেঁড়া পেটাতে হতো না।

এবারের প্রতিপাদ্য

ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশনের আমরা বাংলা করেছি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন বা হ্রাস আর দুর্যোগ প্রশমনের মধ্যে যে ফারাক বিস্তর, সে কথা কে কাকে বোঝাবে। গার্ল চাইল্ডস আর কন্যাশিশু যে এক বিষয় নয়, সেটার এলেম দিতে দিতে হয়রান সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি তাফসিরসহ ব্যাখ্যা করে বই পর্যন্ত লিখেছেন বিষয়টি খোলাসা করার জন্য, কিন্তু পারেননি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ‘ছোটখাটো’ বিষয় নিয়ে পেরেশানির কোনো ফায়দা নেই। যে দেশে আস্ত অশ্বত্থগাছকে দিব্যি বটগাছ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, সে দেশে বুঝে কথা বলার জন্য তোয়াজ করাটা বেকারের শামিল।

যাহোক, এবারের দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্যোগের ঝুঁকি আর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে একটা প্রতীকী ছবিও অবমুক্ত করা হয়েছে। সেই ছবিতে সাদা দুটি হাত কমলালেবুর মতো পৃথিবীটাকে নিচে থেকে আলতো করে ধরে রেখেছে। দেখে কারও কারও কাজী নজরুলের কথা মনে পড়তে পারে ‘বিশ্ব–জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। বর্ণবাদবিরোধীরা প্রশ্ন করতেই পারেন, কেন দুটি হাতই সাদা? আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কি সব সময় সাদা রঙের হাত দিয়েই আসতে হবে। অন্য রঙের মানুষদের কাছ থেকেও সেটা আসতে পারে। তবে উন্নত দেশগুলোর ভুলের খেসারত দিচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর এর দায় প্রধানত উন্নত দেশগুলোরই। ঝুঁকি কমাতে পারলে ভালো, কিন্তু কোনোমতেই ঝুঁকি আর বাড়াতে দেওয়া যাবে না। উন্নয়নের যেকোনো ব্যবস্থাপত্র খোলাখুলি যাচাই–বাছাই আর জনগণের অনুমতি না নিয়ে বাস্তবায়ন করার পথ বন্ধ করাই হোক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য।

লেখক: গবেষক, nayeem 5508 @gmail.com