আট কারণে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা

বন্যায় মানিকগঞ্জ-ঝিটকা পাকা সড়কের তিন স্থান ধসে গেছে। এ কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জেলা সদর থেকে হরিরামপুর উপজেলায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল দুপুরে ঘিওরের উভাজানী এলাকায়। ছবি: আব্দুল মোমিন
বন্যায় মানিকগঞ্জ-ঝিটকা পাকা সড়কের তিন স্থান ধসে গেছে। এ কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জেলা সদর থেকে হরিরামপুর উপজেলায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল দুপুরে ঘিওরের উভাজানী এলাকায়।  ছবি: আব্দুল মোমিন

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ওই বছর বন্যার পানি ৬৩ দিন ছিল। চলমান বন্যা সেই হিসাবে দ্বিতীয় দীর্ঘতম। ৩৯ দিন পরও বন্যায় পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের মানুষ। অবশ্য এবারের বন্যায় কয়েক দফায় পানি কমেছে-বেড়েছে। উজানে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার স্থায়িত্বকাল দফায় দফায় বেড়েছে। তবে বৃষ্টিই মূল কারণ নয়, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এবারের বন্যা স্থায়ী হওয়ার আটটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এবার বন্যার পানির পরিমাণ ১৯৯৮ সালের চেয়ে অনেক কম হলেও স্থায়িত্ব বাড়ছে। এর কারণ গত কয়েক যুগে দেশের নদ-নদী ও প্লাবনভূমিতে (নদীসংলগ্ন ভূমি, যা নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে তলিয়ে যায়) নানা ধরনের অবকাঠামো ও বসতি নির্মাণের ফলে বন্যার পানি আটকে থাকছে। এমনকি বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোও প্রতিটি নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় না নিয়ে করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৩৩ জেলার কোথাও না কোথাও বন্যার পানি রয়েছে। পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৫৬ লাখ। এর মধ্যে ৭৬ হাজার মানুষ সরকারিভাবে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে উঠেছে। সড়ক, বাঁধসহ নানা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে তা আবার বাড়তে পারে। এর কারণ উজানের ভারতীয় অংশে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বারবার পানি ওঠানামা করায় সামনের দিনগুলোতে নদীভাঙন আরও তীব্র হতে পারে।

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ চলতি সপ্তাহে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে চলমান বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আটটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় এখন পানি ঢুকেছে কিন্তু নামছে না, সেসব এলাকার
বেশির ভাগই নিচু ও চর। এসব এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ ও নগরায়ণ হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত মাটির নিচে নামতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, জলাভূমি ও প্লাবনভূমিগুলোর বড় অংশ বেদখল হয়ে গেছে। ফলে নদীগুলোর মধ্যে আন্তসংযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণেও পানির প্রবাহ ধীরগতিতে হচ্ছে। তৃতীয়ত, বন্যা মোকাবিলায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা নদীর সঙ্গে প্লাবনভূমির যে সম্পর্ক ছিল, তা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

চতুর্থ কারণ হিসেবে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় যেসব বনভূমি ছিল, তা কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। ফলে ভূমি থেকে বিপুল পরিমাণ মাটি গিয়ে নদীতে পড়ছে। এতে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে উঠছে। পঞ্চম কারণ, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে প্লাবনভূমির মধ্যেও সড়ক নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা তৈরি করা হয়েছে। ষষ্ঠ বিষয়টি হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীগুলোর উজানে জলাধার, বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে, যা নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। সপ্তম কারণ, বাঁধ ও নানা অবকাঠামোর কারণে নদীতীরবর্তী এলাকার তাপমাত্রাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বৃষ্টিপাত বেড়ে গেছে।

বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অষ্টম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীর চারদিকে অবকাঠামো নির্মাণ বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে নদীতে পলির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে পানি দ্রুত বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।

বন্যা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এমনিতেই পানির প্রবাহ বেড়ে গেছে। মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে ওঠায় বাড়তি বৃষ্টিপাত এর সঙ্গে যোগ হয়েছে। আর অবকাঠামোগুলোর মাঝখানে পানি আটকে থাকায় বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে। তিনি বলেন, হাওরের বুক চিরে রাস্তা বানানোসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। এসব তৎপরতা বন্ধ না করলে হাওর এলাকায়ও দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা হতে পারে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, বন্যাকবলিত এলাকার ৯৩ শতাংশ মানুষই বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, এবারের
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির ধরনটা একটু ভিন্ন। মূলত নিচু এলাকার বাসিন্দারা বন্যায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট আছে। পানি নেমে যাওয়ার পরও এসব মানুষকে ত্রাণ ও অন্যান্য উপকরণ সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা করে পুনর্বাসনের কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে।