দেশে আগের দশকের তুলনায় গত দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষার আগে–পরে বেড়েছে বৃষ্টিপাত।
বাংলাদেশে দুই দশকে ডেঙ্গুর প্রকোপের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তনের যোগসূত্র রয়েছে। চলতি শতকের প্রথম দশকের তুলনায় দ্বিতীয় দশকে দেশের তাপমাত্রা প্রায় আধা ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। দুই দশকে ভরা মৌসুমে বৃষ্টিপাত কমেছে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি। কিন্তু বর্ষার আগে–পরে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে।
তাপমাত্রা বাড়লে মশার দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু দ্রুত বেড়ে যায়। মশার রক্ত হজমের শক্তিও বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও এমনটি ঘটেছে। আর বর্ষার ধরনে পরিবর্তনের কারণে মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে।
এনটোমোলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার জার্নাল অব মেডিকেল এনটোমোলজিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৮ জানুয়ারি ‘টু ডিকেডস অব এনডেমিক ডেঙ্গু ইন বাংলাদেশ: ট্রেন্ডস, সিসোনালিটি অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট অব টেমপারেচার অ্যান্ড রেইনফল প্যাটার্নস অন ট্রান্সমিশন ডায়নামিকস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক এই কারণের পাশাপাশি দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী—ডা. মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ
গবেষকেরা ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বর্ষার আগে–পরে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশা দমনে ওষুধের প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে না। তাই ডেঙ্গু দমনে পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা জরুরি।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি এই গবেষণায় তথ্য-প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক এই কারণের পাশাপাশি দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী।
২০০০ থেকে ২০২২ সাল—এই ২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। অর্থাৎ প্রতিবছর ডেঙ্গুতে গড় আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৬১৯। প্রথম দশকে বছরে গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজারের বেশি। কিন্তু পরের দশকে তা ১৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। প্রথম দশকে ডেঙ্গুতে বছরে গড় মৃত্যু ছিল ২১। পরের দশকে তা বেড়ে হয় ৪৬।
প্রথম দশকে ডেঙ্গুতে গড় আক্রান্ত ২ হাজার, পরের দশকে ১৮ হাজার।
প্রথম দশকে বছরে গড় মৃত্যু ২১, পরের দশকে ৪৬।
১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এডিস মশায় ডেঙ্গু ভাইরাসের বৃদ্ধি শুরু হয়। দেশে তাপমাত্রা এর চেয়ে অনেক বেশি
বর্ষা মৌসুমের আগে–পরে বৃষ্টির কারণে মশার প্রজনন বেড়েছে।
ভবিষ্যতে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে ডেঙ্গু বা মশাবাহিত রোগ আরও বাড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দশকে (২০১১ থেকে ২০২২) এর আগের দশকের চেয়ে দেশের তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রথম দশকে গড় তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরের দশকে বেড়ে হয়েছে ২৬ দশমিক ৮৪।
গবেষণার সঙ্গে জড়িত যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বলেন, এই তাপমাত্রা বাংলাদেশে গড়ে ৪ হাজার ২৯২ ডিগ্রি-ঘণ্টা সমপরিমাণ অতিরিক্ত তাপ তৈরি করে! মশার দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ঢুকতে ও সংক্রমিত হওয়ার মতো সক্ষম হতে (ইনকিউবেশন) দরকার মাত্র ৩৪৯ ডিগ্রি-ঘণ্টার সমপরিমাণ তাপমাত্রা। ফলে এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা এডিস মশার দেহে ডেঙ্গু ভাইরাসের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হচ্ছে মাসওয়ারি বৃদ্ধির প্রবণতা। বাংলাদেশে ২৩ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সব সময় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে।
‘ডিগ্রি ঘণ্টা’ একটি তাপমাত্রা পরিমাপ সূচক একক। যেমন কেউ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘণ্টা থাকলে অথবা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ ঘণ্টা থাকলে সে ১০ ডিগ্রি-ঘণ্টা তাপের মুখোমুখি হয়। গবেষকেরা বলেন, ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এডিস মশার মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাসের বৃদ্ধি শুরু হয়। বাংলাদেশের তাপমাত্রায় ইনকিউবেশন সম্পন্ন হতে সময় লাগে গড়ে আট দিন।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাপ দীর্ঘস্থায়ী হলে মশার বংশবিস্তার বেড়ে যায়। তবে এখানে আরও অনেক বিষয় কাজ করে। যেমন দেশে সারা বছর ধরে মশার ধারাবাহিক জরিপ হয় না। আবার যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কতটুকু কার্যকর, তা–ও নিয়মিতভাবে দেখা হয় না।
এই তাপমাত্রা বাংলাদেশে গড়ে ৪ হাজার ২৯২ ডিগ্রি-ঘণ্টা সমপরিমাণ অতিরিক্ত তাপ তৈরি করে! মশার দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ঢুকতে ও সংক্রমিত হওয়ার মতো সক্ষম হতে (ইনকিউবেশন) দরকার মাত্র ৩৪৯ ডিগ্রি-ঘণ্টার সমপরিমাণ তাপমাত্রা। ফলে এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা এডিস মশার দেহে ডেঙ্গু ভাইরাসের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার
বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এডিস মশার বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। সেখানেও দশকওয়ারি পরিবর্তন দেখা গেছে। প্রথম দশকের তুলনায় দ্বিতীয় দশকে বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে ৩১৪ মিলিমিটার। এর মধ্যে ৩০৮ মিলিমিটারে কমেছে বর্ষার সময় (জুলাই থেকে অক্টোবর)। আবার দ্বিতীয় দশকে (২০১১ থেকে ২০২২) বর্ষা মৌসুমের আগে–পরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে। এতে মশার প্রজনন ও ডেঙ্গু সংক্রমণের সময়কাল বাড়ছে।
প্রথম দশকে (২০০০ থেকে ২০১০) মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৮ মিলিমিটার। পরের দশকে কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৬৪ মিলিমিটার। ডেঙ্গুতে মোট সংক্রমণের প্রায় ৭৭ শতাংশের বেশি হয়েছে এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। আর আগস্ট থেকে মার্চের মধ্যে হয়েছে ১৬ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্যবিদ নাজমুল হায়দার বলেন, বর্ষার আগে–পরে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় মশার প্রজননও বেড়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু নির্মূলে তৎপরতা দেখা যায় কেবল বর্ষা মৌসুমে। আগে-পরে বৃষ্টির কারণে মশার অস্বাভাবিক বংশ বিস্তার আমলে নেওয়া হচ্ছে কম।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ভবিষ্যতে এমন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, সঙ্গে ডেঙ্গু বা মশাবাহিত অন্যান্য রোগ আরও বাড়তে পারে।
গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হচ্ছে মাসওয়ারি বৃদ্ধির প্রবণতা। বাংলাদেশে ২৩ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সব সময় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে।
বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে জীবাণুবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বাংলাদেশে এডিসবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। এ বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত।
গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও সংক্রমণ আগের ২৩ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতজন মারা গেছেন, সেই সংখ্যা আগের ২৩ বছরের মৃত্যুর চেয়ে বেশি। সংক্রমণও আগের ২৩ বছরকে ছাড়িয়ে গেছে।
গবেষণায় ভবিষ্যতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে সমন্বিত এবং ব্যাপকভিত্তিক মশানিধন কর্মসূচি। এতে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। মশা ও রোগীর ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির কথাও বলা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, রোগ ও প্রকৃতির এই পরিবর্তনের বাস্তবতাকে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কার্যক্রমে পরিবর্তন আনার একটা বার্তা দিচ্ছে এই গবেষণা।