সন্তান জন্মদানের পর আবার দ্রুত খেলায় ফিরতে চেয়েছিলেন সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা (২৪)।
বড় ভাই ফজলুর রহমান ও মা আবিরন বিবির ভাষ্য, হাসপাতালে গেলেই অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম (সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশন) দিতে হতে পারে—এ আশঙ্কায় রাজিয়া বাড়িতে প্রসব করাতে চেয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম হলে দ্রুত খেলায় ফিরতে পারবেন না—এমন শঙ্কা ছিল তাঁর। খেললে টাকা, না খেললে শূন্য হাত। তাই দ্রুত খেলায় ফিরতে স্বাভাবিক প্রসব চেয়েছিলেন তিনি।
দেশে সি-সেকশনের উচ্চহারের তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ অনুসারে, দেশে প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটির বেশি শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে। এই হার ৪১ শতাংশের বেশি। খুলনা বিভাগে এই হার সর্বোচ্চ প্রায় ৫৮ শতাংশ।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচাতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
রাজিয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, নারী ফুটবলারদের মা হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী ফুটবল শাখার প্রধান মাহফুজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, নারী ফুটবল দলের জন্য ফেডারেশন অনেকটা ধরেবেঁধে স্পনসর জোগাড় করে। সরকারের কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। ক্লাবগুলোও দরিদ্র। নারীদের যখন কেউ খেলেন, তখন তারা টাকা দেয়। জাতীয় দল বা ক্লাবগুলোর কোথাও মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতার ব্যবস্থা নেই।
জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে ক্লাব ফুটবলের কোনো কাঠামো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় খেলার জন্য ক্লাবগুলো ফেডারেশনের ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরের নারী ফুটবলারদের নেয়। পুরুষ খেলোয়াড়েরা ক্লাবে পুরো মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। নারীরা সেভাবে দীর্ঘ সময় খেলার সুযোগ পান না। খেলার আগে দুই-আড়াই মাসের জন্য তাঁরা চুক্তিবদ্ধ হন।
তবে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম হলে নারী খেলোয়াড় আর ফুটবল খেলতে পারবেন না—এমনটা মনে করেন না জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ও বর্তমান ফিজিওথেরাপিস্ট লাইজু ইয়াসমিন। তাঁদের ভাষ্য, অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম হলে ছয় মাস থেকে বছর খানেক পর্যন্ত খেলায় ফেরার সুযোগ থাকে না।
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীনাথপুরের বাবার বাড়িতে এক ছেলেসন্তানের জন্ম দেন রাজিয়া। বাড়িতে ধাত্রীর হাতে তাঁর প্রসব করানো হয়। সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন রাজিয়া। রাজিয়ার ভাই ফজলুর রহমান (২৬) প্রথম আলোকে বলেন, বোনের প্রসবের দিন দুজন পল্লিচিকিৎসক ও তিনজন ধাত্রীকে বাসায় ডেকে আনা হয়েছিল। তাঁরা রাজিয়াকে হাসপাতালে নিতে চাইলেও বোন যেতে চাননি। রাজিয়া বলতেন, স্বাভাবিক প্রসব করবে। না হলে হাসপাতালে যাবে। রাজিয়ার ভয় ছিল, হাসপাতালে গেলে সিজার হবে। তাহলে খেলায় ফিরতে দেরি হবে। রাজিয়া সব সময় বলতেন, সিজার করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চান না। খেলায় ফিরতে চান। কারণ, না খেললে ক্লাব কোনো টাকা দেয় না।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন রাজিয়া। বাবা নূর আলী মারা যাওয়ার পর মায়ের দায়িত্ব বর্তেছিল রাজিয়ার ওপর।
রাজিয়ার শ্বশুরবাড়ি রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে। স্বামী ইয়াম রহমান গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, রাজিয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নারী ফুটবলারদের মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তাঁদের আরও কাউন্সেলিং (পরামর্শ) দরকার। রাজিয়া মানসিকভাবে শক্তিশালী ও খেলায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি সন্তান জন্মদানের সময় কেন পাড়াগাঁয়ে গেলেন? গেলেনই যখন, তখন কেন হাসপাতালে গেলেন না? এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
গোলাম রব্বানী আরও বলেন, অস্ত্রোপচার হলেও খেলায় ফেরা যায়। তা ছাড়া বেঁচে থাকলে তবেই তো ফুটবল। খেলার কথা না ভেবে রাজিয়ার নিজের জীবনের কথা ভাবা দরকার ছিল।
মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে নারী ফুটবলারদের কখনো সচেতন করা হয় কি না, জানতে চাইলে গোলাম রব্বানী বলেন, ‘নারী কোচ, ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন। তাঁরা এই বিষয়গুলো দেখেন।’
জাতীয় নারী ফুটবল দলের ফিজিওথেরাপিস্ট লাইজু ইয়াসমিন বলেন, একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম দিলে আর খেলা যায় না বা সমস্যা হয়। যেকোনো অস্ত্রোপচার থেকে সেরে উঠতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগে। এ ক্ষেত্রেও তা–ই। অস্ত্রোপচারের পর ছয় মাস পর্যন্ত নিজেকে তৈরি করতে হয়। সেলাই শুকাতে সময় দিতে হয়। নারীদের প্রসব পরবর্তী কিছু বিষণ্নতা দেখা দেয়; যদিও দেশে এটাকে গণনা ধরা হয় না।
লাইজু ইয়াসমিন বলেন, রাজিয়া কখনো এ বিষয়ে কাউন্সেলিং নিয়েছিলেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। কারণ, রাজিয়া জাতীয় দল থেকে চলে যাওয়ার পর তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন।
এখন জাতীয় দলে মেয়েদের এই কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে লাইজু ইয়াসমিন বলেন, ‘অফিশিয়ালি কোনো কথা হয় না। অনেক মেয়ের গর্ভাবস্থায় কি করতে হবে, সেটা জানার বয়সও হয়নি। তবে কথা প্রসঙ্গে মেয়েদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ে জানানো হয়।’
জাতীয় দলের সাবেক নারী ফুটবলার তৃষ্ণা চাকমা জানান, তাঁর এখন ৮ বছর বয়সী সন্তান আছে। মা হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলে থাকার সময় পর্যন্ত তিনি বিয়ে করেননি। জাতীয় দল ছাড়ার পরের বছর বিয়ে করেন। বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের পর জাতীয় দলে তাঁর আর ফেরা হয়নি। তিনি এমন কোনো নারী ফুটবলারকে দেখেননি, যিনি সন্তান হওয়ার পর জাতীয় দলে ফিরেছেন।
তৃষ্ণা বলেন, পুরুষ ফুটবল লিগ নিয়মিত হয়। নারী লিগ নিয়মিত হয় না। পুরুষেরা ক্লাবগুলোয় পুরো মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এ কারণে তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বেশি। নারীদের লিগ যখন হয়, তখন খেলার জন্য ডাকা হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পান নারী ফুটবলাররা। তাঁদের জন্য কোনো মাতৃত্বকালীন ছুটি বা ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। যখন খেলা হয়, তখন টাকা দেওয়া হয়।
করোনা মহামারির আগে বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে অন্তঃসত্ত্বা নারী খেলোয়াড়েরা বৈষম্যের শিকার হতেন। এখন গর্ভকালীন অধিকার নিয়ে ফিফার নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুসারে, গর্ভধারণের কারণে খেলোয়াড়ের চুক্তি বাতিল করা যাবে না। খেলোয়াড়ের চুক্তি বাতিল করা হলে ক্লাবগুলোকে ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। এমনকি ক্লাবগুলো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে তৃষ্ণার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ফিফার তো কত নিয়মই আছে। কতটুকু আর এখানে মেনে চলা হয়।
রাজিয়ার ভাই ফজলুর রহমান জানান, ২০১৯ সালে জাতীয় দল ছাড়ার পর কয়েকটি ক্লাবে খেলেন রাজিয়া। গর্ভধারণের তিন মাসের সময় তিনি সাতক্ষীরার একটি ক্লাবে খেলেছিলেন। ঢাকার একটি ক্লাব থেকে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু গর্ভধারণের কথা জানার পর তিনি আর যোগ দেননি।
ফজলুর রহমান বলেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর দ্রুত খেলায় ফিরতে চেয়েছিলেন তাঁর বোন। ফজলুরের আক্ষেপ, তাঁর বোন জাতীয় দলে খেলেছিলেন। দেশের জন্য তাঁর বোনের অবদান আছে। তাঁরা হতদরিদ্র পরিবার। থাকার মতো ভালো ঘর নেই। কিন্তু সরকার কখনো রাজিয়ার খোঁজ করেননি।
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে ধরা গলায় রাজিয়ার মা আবিরন বিবি প্রথম আলোকে বললেন, ‘একটা কুথা শোনো, দুনিয়া কেমন জানো, কেউ কারও (কাউকে) দিখে না। সবাই সবাইরে দিখলে সবার ভালো হতো। কেউ পাঁচতলা দালান দেচ্ছে। গরিব মানুষ গরিবই আছে।’
আবিরন বিবি আরও বলেন, ‘আমার বাইচ্চা (রাজিয়া) এত দিন খেলা করিছে, কোনো দিন কিছু পায়নি। দু-এক বছর বসি খাব—এমন কিছু সরকারের কাছে পাইনি। স্বামী নেই, ওই বাইচ্চা যা দিত, তা–ই খ্যাতাম। তিন মাস পরপর ১ হাজার ৫০০ টাকা বিধবা ভাতা পাই। তা দিয়ে কি চলে! শোনো বাবা, আর দুঃখের কথা বোলো না। আর শুনো না (শুনতে চেয়ো না)। মনের আগুন আর বের কোরো না।’