মীর্জা গোলাম পীর আরমানিটোলায় এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি এটি ওয়াক্ফ করে যান। তখন লোকমুখে এর নাম ছিল ‘মীর্জা সাহেবের মসজিদ।’ ১৯২৬ সালে মসজিদটি প্রথমবারের মতো সংস্কার করে গম্বুজগুলোতে অসংখ্য তারা ফুটিয়ে তোলা হয়। সেই থেকে লোকে বলতে থাকে ‘তারা মসজিদ’
‘আপাদমস্তক’ শব্দবন্ধটি কি কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে খাটবে? ব্যাকরণবিদেরা হয়তো আপত্তি তুলতে পারেন, কিন্তু ‘তারা মসজিদ’–এর সামনে দাঁড়িয়ে এই শব্দটিই মনে এল।
মসজিদটির মাটি ছুঁয়ে থাকা দেয়াল ও মেঝে থেকে শুরু করে ছাদের ওপরের গম্বুজের চূড়ার শীর্ষ পর্যন্ত অনিন্দ্যসুন্দর নকশায় আবৃত্ত। দুর্লভ প্রাচীন টাইলস, রংবেরঙের কাচের টুকরা, চিনামাটির ফলকসহ হরেক রকমের উপকরণ দিয়ে সুনিপুণভাবে মসজিদটির ভেতর–বাইরের সর্বাঙ্গ অলংকৃত করে তোলা। নকশা করা এই পদ্ধতির নাম ‘চিনি টিকরি’। বিশেষ করে ভেতরে বাতি জ্বালালে দেয়ালে রঙিন কাচের টুকরা কেটে বসানো চিনি টিকরির নকশা এমন বর্ণিল হয়ে ওঠে যে প্রথম দর্শনে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
তারা মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা তোফাজ্জাল হোসেন শনিবার জোহর নামাজ শেষে প্রথম আলোকে বলছিলেন, মুসল্লিরা তো নামাজ আদায় করতে আসেনই; বহু বিদেশি পর্যটক, রাষ্ট্রদূত, গণ্যমান্য অতিথিরাও ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ দেখতে আসেন দর্শনীয় স্থান হিসেবে। যেন তাঁর কথার সত্যতার প্রমাণ দিতেই খানিক পরেই সেখানে বেসরকারি এক পর্যটন সংস্থার ব্যবস্থাপনায় ঢাকা শহর ঘুরে দেখার প্যাকেজে একদল জাপানি পর্যটক এলেন তারা মসজিদ দেখতে। ঢাকার দর্শনীয় স্থান হিসেবে তারা মসজিদের সচিত্র বিবরণ রয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খয়রাত সড়কের ৮ নম্বর হোল্ডিং ভবনটিই হলো বিখ্যাত ‘তারা মসজিদ’। গুলিস্তান থেকে রওনা দিলে সিদ্দিক বাজার সড়ক হয়ে বংশাল দিয়ে সোজা পশ্চিমে এগিয়ে গেলে পড়বে মাহুতটুলী চৌরাস্তার মোড়। হাতের বাঁ অর্থাৎ দক্ষিণে মোড় নিয়ে কিছু দূর গেলেই ডানে আবুল খয়রাত রোড। সামনে আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয়, তারপরই হলো তারা মসজিদ।
তারা মসজিদের বয়স নিয়ে মতপার্থক্য আছে। প্রাচীন মসজিদগুলোতে সাধারণত যেমন শিলালিপি থাকে, এই মসজিদে নির্মাণকাল উল্লেখ করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশেষজ্ঞ মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে মসজিদটির নির্মাণকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, নির্মাণকাল উনিশ শতকের প্রারম্ভে। এর নির্মাতা ছিলেন ধনাঢ্য জমিদার মীর্জা গোলাম পীর বা মীর্জা আহমেদ জান। তাঁর পূর্বপুরুষ মীর আবু সাইদ তুরস্ক থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন, অষ্টাদশ শতকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঢাকার সম্ভ্রান্ত জমিদার মীর আশরাফ আলীর পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে মীর্জাদের ব্যবসা–বাণিজ্য এবং সামাজিক প্রভাব–প্রতিপত্তি বেশ বেড়েছিল। তিনি যে এলাকায় থাকতেন, সেই এলাকার নামকরণও হয়েছিল তাঁর নামানুসারে ‘আলে আবু সাঈদ’। পরে এই মহল্লাই আরমানিটোলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মীর্জা আবু সাঈদের নাতি মীর্জা গোলাম পীর আরমানিটোলায় এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এটি ওয়াক্ফ করে গিয়েছিলেন। তখন লোকমুখে এর নাম ছিল ‘মীর্জা সাহেবের মসজিদ।’ মীর্জা গোলাম পীর ইন্তেকাল করেন ১৮৬০ সালে। তারা মসজিদের আগের রূপটি এখন আর নেই। প্রথম দিকে এমন অলংকৃতও ছিল না। মোগল স্থাপত্যরীতির তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ ছিল বেশ সাদামাটা ধরনের।
তিন গম্বুজ তারা মসজিদটি ছোট আকারের ছিল। দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। সম্প্রসারিত করে ছাদে তিন গম্বুজের সঙ্গে আরও দুটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। এখন পরিবর্ধিত মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৭০ ফুট ও প্রস্থে ২৬ ফুট।
১৯২৬ সালে মসজিদটি প্রথমবারের মতো সংস্কার করেন আরমানিটোলার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী। তিনি বিপুল অর্থ খরচ করে জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত মানের টাইলস, মার্বেলসহ মূল্যবান নির্মাণসামগ্রী এনে মীর্জা সাহেবের মসজিদটির সংস্কার করেন। এ সময় গম্বুজ ও ভেতর–বাইরের দেয়াল ফুল, লতাপাতা ও নান্দনিক নকশায় অলংকৃত করা হয়। মূল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয় বারান্দা।
গম্বুজগুলোতে সাদা ও নীল রঙের মার্বেল ও টাইলসে অসংখ্য তারা ফুটিয়ে তোলা হয়। সেই থেকে মসজিদটির নাম পাল্টে যায়। লোকে বলতে থাকেন ‘তারা মসজিদ’।
প্রায় ৩০ বছর থেকে স্থানীয় বাসিন্দা মাওলানা তোফাজ্জাল হোসেন মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করছেন তারা মসজিদে। এখন ইমামের দায়িত্বে আছেন মাওলানা শফিকুল ইসলাম। মসজিদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হলো তাঁদের সঙ্গে।
তাঁরা জানালেন, এই মসজিদের দ্বিতীয় দফায় সংস্কার হয়েছে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিশেষ উদ্যোগে। তিনি ১৯৮৫ সালের ৮ মার্চ তারা মসজিদে নামাজ আদায় করতে এসেছিলেন। তখন তিন গম্বুজ তারা মসজিদটি ছোট আকারের ছিল। দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। তিনি মসজিদের মূল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন। সেই বছর থেকেই কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৮৭ সালে। পুরোনো মসজিদের উত্তর প্রান্ত সম্প্রসারিত করে ছাদে তিন গম্বুজের সঙ্গে আরও দুটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। এখন পরিবর্ধিত মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৭০ ফুট ও প্রস্থে ২৬ ফুট।
সম্প্রসারিত হলেও আগের অলংকরণের জন্য আগের মতো একই রকম জাপানি টাইলস প্রভৃতি পাওয়া যায়নি। অনেকটা কাছাকাছি টাইলস বসানো হয়েছে নতুন অংশে। ফলে একটু খেয়াল করলেই নতুন ও পুরোনো অংশ আলাদা করে চেনা যায়।
দ্বিতীয় দফা সংস্কারের পর ১৯৮৭ সাল থেকেই তারা মসজিদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন জানালেন, আগে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলেন। গত বছর থেকে এ দায়িত্ব ওয়াক্ফ প্রশাসকের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ওয়াক্ফ প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে একটি হেফজখানা ও মক্তব এবং লিল্লাহ বোর্ডিং রয়েছে। সরকারি অনুদান ও এলাকাবাসীর দানে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মানুষের জন্য করা হয় ইফতারের আয়াজন।
তারা মসজিদের ভেতরে চারটি কাতার এবং বারান্দায় আছে তিনটি কাতার। এতে প্রায় ২৮৫ জন মুসল্লি এখানে জামাতে দাঁড়াতে পারেন। দ্বিতীয় বার সংস্কারের সময় পুরোনো বারান্দার সামনেও অনেকটা জায়গা মার্বেল পাথরের ফলক পেতে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অংশের ওপর এখন ত্রিপলের ছাউনি টাঙানো হয়েছে রমজান মাস শুরুর দুই দিন আগে। ফলে এখন সামনে থেকে তারা মসজিদের তারকাখচিত সুদৃশ্য গম্বুজ আর মিনারগুলো দেখা যাচ্ছে না। তবে এ অংশ ও সামনের মাঠ মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। তা ছাড়া দুই ঈদের জামাতও হয় এখানে।
মসজিদের বারান্দার সামনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া অনেকখানি খোলা জায়গা আছে মাঠের মতো। মাঝখানে তারা আকৃতির ফোয়ারা। এটাও দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের সময় এটা তৈরি করা। ফোয়ারার চারপাশ আর মাঠের ভেতর দিয়ে চলাচলের জন্য মার্বেল পাথরের ফলক বিছানো রাস্তা। মাঠসহ পুরো মসজিদটি অলংকৃত লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। অস্বীকার করার উপায় নেই পুরোনো ঢাকার যানবাহনে ঠাসা সরু গলি আর গায়ে গায়ে লাগানো ঘরবাড়ি, দোকানপাটের ঘিঞ্জি পরিবেশে ‘তারা মসজিদ’ সত্যিই এক দর্শনীয় নিদর্শন।