চাইলেই যে কাউকে ধরে নিয়ে বা আটকে রেখে ‘মনের ঝাল মিটিয়ে’ পেটানোর ক্ষমতা রাখেন—এমন মানুষের (পড়ুন দুর্বৃত্ত) সংখ্যা দেশে গত এক যুগে নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কারও ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেও সাধারণ মানুষ বড়জোর মন থেকে ‘কষে গালি’ দিতে পারেন। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা ‘অর্জন’ করতে চাইলে কারও না কারও বা কোনো না কোনো ‘ছায়াতলে’ থাকতে হয়। এই ছায়া ‘ক্ষমতার’।
ক্ষমতার যাঁরা সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম, তাঁরাও একধরনের ‘দাপট’ তৈরি করতে পারেন। কখনো সেটি দেখা যায় ক্যাম্পাসে, কখনো আশপাশে, কখনো–বা চারপাশে। তাঁদের কারও পদপদবি থাকে, কারও ক্ষেত্রে এসব ‘স্ট্যাটাস’ না থাকলেও চলে। শুধু ‘ছায়াতলে’ থেকেই তাঁরা কখনো ‘দাপুটে’ কখনো–বা ‘মারকুটে’ ভূমিকা নিতে পারেন। সেটি কেমন হতে পারে, তার সবশেষ উদাহরণ (পড়ুন শিকার) হচ্ছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ শাহ।
তাঁর ‘অপরাধ’, গত কয়েক মাসে অস্ত্র হাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের লাগাতার সংঘর্ষ, চাঁদা দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর, অছাত্রদের হলের কক্ষ দখল করে থাকাসহ বেশ কিছু বিষয়ে তিনি প্রতিবেদন করেছিলেন। এর ‘ফল’ হাতেহাতে নয়, বেদম পিটিয়ে তাঁকে ‘বুঝিয়ে দিয়েছেন’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী।
মোশাররফকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটানোর সময় তাঁকে এ–ই বলেও শাসানো হয়েছে, যাতে ছাত্রলীগ নিয়ে তিনি আর কোনো প্রতিবেদন না করেন। ছাত্রলীগের ওই নেতা-কর্মীরা তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আর নিউজ করিস, তারপর দেখব তোরে কে বাঁচাতে আসে। ছাত্রলীগকে নিয়ে কোনো নিউজ হবে না।’
মোশাররফের কপাল ‘ভালো’ তিনি এযাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছেন। অবশ্য কপালের দগদগে ঘা মুছতে চারটি সেলাই লেগেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মোশাররফের কানের পর্দায় ছোট ছিদ্র হয়েছে, হাত-পা ফুলে গেছে, এক হাতের কবজি মচকে গেছে। সারা শরীরে ক্রিকেট স্টাম্পের আঘাত নিয়ে তিনি এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
মোশাররফের ঘটনা মনে করিয়ে দিল এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির ১০টি নির্দেশনার কথা। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জন্য দেওয়া এই নির্দেশনার ৮ নম্বরে রয়েছে ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধুদের দায়িত্ব পালনে সব সময় সহযোগিতা করা’। আর ১০ নম্বর নির্দেশনা হচ্ছে—‘সাংগঠনিক শৃঙ্খলাপরিপন্থী, নিরাপত্তা বিঘ্নকারী, বেআইনি, ইভ টিজিং, র্যাগিং ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না হওয়া’।
মোশাররফকে পেটানোর ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদকর্মীকে মারধরের ঘটনা এ বছর এটিই প্রথম নয়; এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মার্জান আক্তারকে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। তখন তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এখনো কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ কী করছে, তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফের বক্তব্যে। মোশাররফকে মারধরের ঘটনার পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল। সবশেষ গতকাল রোববার প্রথম আলোর সংবাদকর্মী মোশাররফ শাহকে মারধরের খবর আমরা দেখেছি।এটি বিব্রতকর হওয়ায় আমরা কমিটি বিলুপ্ত করেছি।’ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীকে পেটাচ্ছেন অথবা কাউকে হল থেকে বের করে দিচ্ছেন—এ ধরনের ঘটনা গত কয়েক বছরে মানুষ এত বেশি ঘটতে দেখেছে যে এর ‘সংবাদমূল্যও’ এখন কমে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষেরও যেন বিষয়টি গা-সওয়া হয়ে গেছে।
মোশাররফের ঘটনা মনে করিয়ে দিল এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির ১০টি নির্দেশনার কথা। সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জন্য দেওয়া এই নির্দেশনার ৮ নম্বরে রয়েছে ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধুদের দায়িত্ব পালনে সব সময় সহযোগিতা করা’। আর ১০ নম্বর নির্দেশনা হচ্ছে—‘সাংগঠনিক শৃঙ্খলাপরিপন্থী, নিরাপত্তা বিঘ্নকারী, বেআইনি, ইভ টিজিং, র্যাগিং ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না হওয়া’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের জন্য ‘অবশ্যই পালনীয়’ ১০টি নির্দেশনা এসেছিল বিশেষ প্রেক্ষাপটে। এর কিছু দিন আগে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় পুলিশ পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় ধরা পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রলীগ নেতা। ওই সময় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেত্রীর আরেক ‘কীর্তিতে’ দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। ঘটনাটি ১২ ফেব্রুয়ারির। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় এক ছাত্রীকে।
ছাত্রীকে নির্যাতনের ওই ঘটনায় পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনগুলো হয়তো তখন পছন্দ করেননি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তখন তিনি গণমাধ্যমের কাছে ‘সঠিক দায়িত্বশীলতা’ দাবি করেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ ১০০টি ভালো কাজ করলে একটিও নিউজ হয় না। আর ছাত্রলীগ একটি খারাপ কাজ করলে ১০০টি নিউজ হয়। আমরা গণমাধ্যমের সঠিক দায়িত্বশীলতা দেখতে চাই।’
ছাত্রলীগ সভাপতির ওই বক্তব্যের পর গত ২০ ফেব্রয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিশ্লেষণে লিখেছিলাম, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অপরাধে জড়ালে কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে বা নিজেরা মারামারি করলে সেই খবর প্রচার ও প্রকাশ করা অবশ্যই গণমাধ্যমের দায়িত্ব। সেটি কম করা কিংবা কম গুরুত্ব দেওয়া কোনোভাবেই গণমাধ্যমের জন্য ‘সঠিক দায়িত্বশীলতা’ হতে পারে না।
অবশ্য এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন। এখন ছাত্রলীগ ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধুদের দায়িত্ব পালনে সব সময় সহযোগিতা’ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই অঙ্গীকার হয়তো মোশাররফকে পিটিয়ে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার সময় হঠাৎ ভুলে গিয়েছিলেন ছাত্রলীগের ওই নেতা-কর্মীরা। অবশ্য অঙ্গীকার ভুলে গেলেও তাঁরা অন্তত এটুকু জানেন, আইন ‘নিজস্ব গতিতে’ চললে তা কখনো ‘ক্ষমতার ছায়াতল’ পর্যন্ত পৌঁছায় না।
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো