স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষাকালীন মশা জরিপের তথ্য বলছে, পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার বাসাবাড়িতে এবারই এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি।
মশা মারতে গত জুলাই মাসে ‘চিরুনি অভিযানে’ নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বসে থাকেনি উত্তর সিটিও। তারাও তখন মশকনিধনে সর্বাত্মক অভিযানে যায়। যার নাম দেওয়া হয় ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’। ঘটা করে শুরু করা দুই সিটির ‘অভিযান’ শেষ পর্যন্ত কী ফল দিয়েছে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না।
দেশের ইতিহাসে এবারই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আক্রান্তও সর্বোচ্চ। বছর শেষ হতে আরও সাড়ে তিন মাস বাকি। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা নিয়ে শঙ্কিত জনস্বাস্থ্যবিদেরা। মশকনিধনে দুই সিটির বিশেষ অভিযান শুরুর এক মাস পর গত আগস্টে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘বর্ষাকালীন মশা জরিপ’ করেছে। এতে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার দুই সিটির বাসাবাড়িতে এবারই এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট সবচেয়ে বেশি। লার্ভার ঘনত্বও আগের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। মশা জরিপের এই ফলাফলই বলে দিচ্ছে চিরুনি অভিযান বা ক্রাশ প্রোগ্রামে আসলে কাজ হচ্ছে না।
ঢাকার দুই সিটিতে মশকনিধনে বিশেষ অভিযান চলার সময় গত জুলাই মাসে দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২০৪ জন। এর পরের মাসে মৃত্যু হয়েছে ৩৪২ জনের। আর চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১২ দিনেই মারা গেছেন ১৫৯ জন (গত সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত মারা গেছেন ১১ জন)। সব মিলিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৭৫২ জনের। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালেই মারা গেছেন ৫৩১ জন। গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ২২৮ জন।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, মশার লার্ভা বা শূককীট থেকে সাত দিনের মধ্যেই কামড় দেওয়ার শক্তিসম্পন্ন মশার জন্ম হয়। আর লার্ভার হিসাবই বলে দেয়, এডিস মশার বিস্তার কতটা হবে। এ চিত্র দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার রাজধানীতে মশা জরিপ করে। এসব জরিপের ফলাফল তারা সিটি করপোরেশনকেও দিয়ে দেয়। প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী সময়ে এ জরিপ হয়। উল্লেখ্য, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা।
ঢাকায় মশার এত বেশি পরিমাণে লার্ভা পাওয়ার অর্থ হলো, এবার ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকার দুই সিটিতে হয়েছে বর্ষাকালীন জরিপ। উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডের ১ হাজার ৩৩৫টি বাড়ি এবং দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডের ১ হাজার ৮১৫টি বাড়িতে এ জরিপ হয়। এতে দেখা যায়, উত্তর সিটির ২৩ ভাগ এবং দক্ষিণ সিটির ১৯ ভাগ বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর আগে গত জুন মাসে প্রাক্-বর্ষা জরিপ হয়। সেখানে উত্তরের ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণের ১৫ শতাংশ বাড়িতে লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। সেই তুলনায় এবার বর্ষা জরিপে মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। তবে ভরা বর্ষায় মশার লার্ভা একটু বেশি পাওয়া যায়।
নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই সিটির মশার জরিপ বলে দিচ্ছে, এসব স্থানে মশা সৃষ্টি হওয়ার উৎস বাড়ছে, প্রজননক্ষেত্র বাড়ছে, আবার এর জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেটাও অনুকূলে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ দুই সিটি নিচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত বছরের বর্ষা জরিপের তুলনায় এ বছরের জরিপে উত্তর সিটিতে ১০ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটিতে ৭ শতাংশ বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে।
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষা জরিপে দেখা গেছে, উত্তর সিটির ৭৫ শতাংশ এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও শিল্প এলাকা-বেগুনবাড়ি-কুনিপাড়া)। ৪৯ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (পল্লবী ও মিরপুরের কিছু অংশ)। দক্ষিণ সিটির ১৯ ভাগ এলাকায় বিআইয়ের পরিমাণ ২০-এর বেশি। সর্বোচ্চ বিআই ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কাকরাইল-সিদ্ধেশ্বরী-পশ্চিম মালিবাগ) ৭৩ শতাংশ। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে (সেগুনবাগিচা-গুলিস্তান-প্রেসক্লাব-ঢাকা মেডিকেল এলাকা) ৭০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান বর্ষা জরিপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের মতো লার্ভার উপস্থিতি আগে দেখিনি।’
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণের চেয়ে উত্তর সিটিতে লার্ভা পাওয়া বাড়ি এবং ওয়ার্ডের হারও বেশি। উত্তর সিটিতে এবার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে প্রথমবারের মতো ‘বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)’ নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। বিটিআই আনতে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কাজ দেয় ঢাকা উত্তর সিটি। এ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনই ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড থেকে বিটিআই আনার কথা বলে আনে চীন থেকে। তবে সেই বিটিআই কার্যকর বলে পরে জানা যায়।
দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে লার্ভা বেশি পাওয়ার বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটির অনেক এলাকায় বসতবাড়িগুলো বেশ ঘন। একটি বাড়ির সঙ্গে আরেক বাড়ির মধ্যে ফাঁকা জায়গা কম। তাই সেখানে পানি জমতে পারে কম। কিন্তু উত্তরের বাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে ফাঁকা। তবে দুই সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ যে কার্যকরভাবে হচ্ছে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে উত্তর সিটিতে মশার লার্ভার উপস্থিতি বেশি, সেখানেই গত পাঁচ বছরে মশা নিধনে বেশি ব্যয় হয়েছে। এর পরিমাণ ২৮৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর দক্ষিণ সিটিতে গত পাঁচ বছরে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি টাকা। তবে দক্ষিণ সিটির মশকনিধনকর্মীদের বেতন এই হিসাবে যুক্ত করা হয়নি।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা দেন, কোনো ওয়ার্ডে ১০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে সেই ওয়ার্ডকে ‘লাল চিহ্নিত’ করা হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে বিশেষ চিরুনি অভিযান চালানো হবে। এখন পর্যন্ত ছয়টি ওয়ার্ডকে লাল চিহ্নিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়ার্ডগুলো হলো ৫ (সবুজবাগ), ২২ (হাজারীবাগ), ৫৩ (পূর্ব জুরাইন), ৬০ (দক্ষিণ রায়েরবাগ ও আশপাশের এলাকা), ১৪ (জিগাতলা ও আশপাশের এলাকা) ও ৫৬ (কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর এলাকা)।
গত জুলাই মাসে দক্ষিণ সিটিতে চলা চিরুনি অভিযানের সময় ১৬টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক ও একজন আলোকচিত্রী। বিশেষ অভিযানে একটি ওয়ার্ডে একসঙ্গে ১৪ জন মশকনিধনকর্মীর ওষুধ ছিটানোর কথা। তবে কখনোই সাতজনের বেশি কর্মীকে ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি। মশকনিধনকর্মীরা ওই সময়ে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে তাঁরা সবাই একযোগে কাজ করতে পারছেন না।
গত পাঁচ বছরে ১৩৬ কোটি টাকা খরচের পরও মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন, এমন প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণে রোগীর সংখ্যা এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
এবার দক্ষিণে মশার লার্ভার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘এখানে ওয়ার্ডের সংখ্যা অনেক বেশি, ঘনবসতিও আছে। ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। তাই লার্ভা বেশি হতেই পারে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেভাবে জরিপ করে, তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে।’
উত্তর সিটিতে পাঁচ বছরে মশা মারার ওষুধ কেনা, মশকনিধনকর্মীদের বেতনসহ (ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োজিত মশকনিধনকর্মী) বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে ২৩১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর মশা নিধনের ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র (ফগার ও স্প্রে মেশিন) কিনতে ব্যয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণা বাবদ খরচ করা হয়েছে আরও ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
মশকনিধনে এত ব্যয়ের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগের যে জরিপগুলো হয়েছে, সেখানে যেসব জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল, নতুন জরিপে ওই জায়গা পরিবর্তন হচ্ছে। ওষুধে যদি কাজ না হয়, তাহলে তো আগের জায়গাগুলোতেই মশার লার্ভা বেশি পাওয়ার কথা। কিন্তু মশা নিজের বাঁচার তাগিদে প্রজননের জায়গা পরিবর্তন করছে। তিনি বলেন, এমন এমন জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কাজ করতে পারেন না। এসব জায়গায় নগরবাসীর অনেক বেশি সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপের সময় আমি গুলশানের তিনটি বাড়িতে গিয়ে সব কটিতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছি।’
দুই সিটিকে লার্ভা জরিপের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। বছরের শুরুতেই তারা বলেছিল, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। এরপর গত জুন ও আগস্টের জরিপেও দেখা গেল এডিসের প্রকোপ বাড়ছেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় মশার এত বেশি পরিমাণে লার্ভা পাওয়ার অর্থ হলো, এবার ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মশকনিধনের কাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে বিপদ আরও বাড়াবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মোহাম্মদ মোস্তফা ও ড্রিঞ্জা চাম্বুগং]