সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেশি শিক্ষার্থীদের

বিদায়ী ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থী।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। দিনে অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে।

সবার জন্য সড়ক নিরাপদ করতে চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশকাঁপানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের দিক থেকে দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছিল। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সড়কে ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ডিসেম্বরে। আর সংখ্যার দিক থেকে তুলনামূলক কম মৃত্যুর ঘটনা এপ্রিলে-৬৩ জন। বিদায়ী ২০২২ সালের মে, জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর-এই চার মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন এবং অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। এদের বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।

সরকার এত প্রতিশ্রুতি দিল, রাস্তায় মৃত্যু কমল না। এটা মানা যায় না।
শাহ আলম, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের বাবা

অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে যত আলোচনা, পরামর্শ, তর্কবিতর্ক—এর প্রায় সবটাই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় বসেই দুর্ঘটনা কমানোর নানা প্রতিশ্রুতি দেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। অথচ ঢাকায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমার বদলে বাড়ছেই। গত বছর সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ২৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এমনকি দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার সড়কেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু—দুটিই এখন সর্বোচ্চ।

পরিবহনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের উদ্যোগে উদাসীনতা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছে।

মোটরসাইকেলচালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন।
সাইদুর রহমান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। তাঁর বাবা শাহ আলম গতকাল শনিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার যায়, সে–ই বোঝে কষ্টটা। নাঈমের মা সারাক্ষণই ছেলের কথা বলতে থাকে। ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে গেছি আমরা। সরকার এত প্রতিশ্রুতি দিল, রাস্তায় মৃত্যু কমল না। এটা মানা যায় না।’

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুসারে, হতাহত ব্যক্তিদের বড় অংশ কর্মক্ষম। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যে মানবসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, এর আর্থিক মূল্য ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহন আইন হয়। এরপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় গত বছরও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি থাকায় দুর্ঘটনায় নিহতের পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা বেশি। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে উদ্যোগ না নেওয়া হলে এই বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া যাবে না।
মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক

দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা বেশি

নিরাপদ সড়ক চাই এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। প্রায় ২৭ শতাংশ দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। রোড সেফটির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৮৪১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ৪৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে। আর সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে সিলেট বিভাগে।

ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার বড় কারণ এখানে যানবাহনের চলাচলও বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫৬ লাখ। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪০ লাখের বেশি।

নিরাপদ সড়ক চাই-এর তথ্য অনুযায়ী, একক জেলা হিসেবে ঢাকায় সর্বোচ্চ গত বছর ৪৫৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৯১ জন। চট্টগ্রাম জেলায় ৩১০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৪৭ জন। ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলায় সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। শরীয়তপুরে ২১টি দুর্ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়েছেন।

ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের যাতায়াতের মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি ঘটেছে। নিরাপদ সড়ক চাই-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-আরিচা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪৪ জন নিহত (গত বছর) হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে।

মোটরসাইকেল হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী

কয়েক বছর ধরেই দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ শতাংশের বেশি। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলচালক এককভাবে দায়ী ছিল বলে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা তিনটি সংগঠনের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তিন সংগঠন হচ্ছে নিরাপদ সড়ক চাই, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও যাত্রীকল্যাণ সমিতি।

মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেলচালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো চরমভাবে বেড়ে গেছে।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে চালকেরা নিয়ম মানছেন না। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে। অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে সঠিক তথ্যই নেই। গণমাধ্যমে সব দুর্ঘটনার খবর আসে না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলো নথিভুক্ত হয় না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা ও হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের।

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি থাকায় দুর্ঘটনায় নিহতের পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা বেশি। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে উদ্যোগ না নেওয়া হলে এই বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া যাবে না। শৃঙ্খলা শুধু টাকাপয়সার বিষয় না, সুশাসনের বিষয়। সড়ক খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।