সাংবাদিক হত্যার বিচার পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা 

দেশে ১৫ বছরে খুন হন ৩০ জন সাংবাদিক। হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার ৩ হাজার ৬৪১ জন।

২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধামরাইয়ে খুন হন সাংবাদিক জুলহাস উদ্দিন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী জুলহাসের পুরোনো ছবি দেখছেন কবিতা ইসলাম। রোববার ধামরাইয়ের গাংগুটিয়ার দক্ষিণ হাতকুড়া গ্রামের বাড়িতে
ছবি: শামসুজ্জামান

কেউ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন, আবার কাউকে খুন করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। দেশে গত ১৫ বছরে ৩০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এসব খুনের ঘটনায় এখনো ন্যায়বিচার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার। আসামিদের অনেকে এখন জামিনে মুক্ত। তাঁদের দাপটে কোনো কোনো ভুক্তভোগী পরিবার অসহায় বোধ করছে বলেও জানা গেছে।

মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিক হত্যার অন্তত চারটি ঘটনায় আসামিরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আসামিরা নানাভাবে মামলার তদন্তে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখেন। বিচার বিলম্বিত হয়। আবার তদন্তের দুর্বলতার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে।

যাদের পেছনে ক্ষমতা আছে, তারাই সাংবাদিকদের ওপর আঘাত হানে। তারা মনে করে, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন

এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিক হত্যার বিচার পেতে স্বজনদের অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। ‘সন্তানের খুনিদের বিচার দেখে মরতে চান’—এমন আকুতির কথা জানিয়েছেন ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের সাংবাদিক জুলহাস উদ্দিনের ৮০ বছর বয়সী মা নূরজাহান বেগম। জুলহাস উদ্দিন ছিলেন বিজয় টেলিভিশনের ধামরাই উপজেলা প্রতিনিধি। ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ধামরাইয়ের বারবারিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই খুনে তিনজন জড়িত। তাঁদের মধ্যে একজন মোয়াজ্জেম হোসেন, তিনি মানিকগঞ্জ সদর থানা যুবলীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখন জামিনে মুক্ত।

ধামরাইয়ের দক্ষিণ হাতকুড়ায় জুলহাসদের বাড়িতে গত রোববার নূরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না তিনি। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই মা বললেন, ‘তিন বছর হইলো জুলহাসে নাই। আমার পোলারে মাইরা ফালাইছে। কবে যে মইরা যাই, ঠিক নাই। মরার আগে ওগো (আসামিদের) শাস্তি হইছে শুনলে একটু শান্তি পাইতাম।’

জুলহাসের দুই সন্তান। ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে আর মেয়ে পঞ্চম শ্রণিতে পড়ে। দুই সন্তানকে নিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানালেন জুলহাসের স্ত্রী কবিতা ইসলাম। 

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ১৫ বছরে সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতনের ৩ হাজার ৬৪১টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন বছরে ৬৮২টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সাংবাদিক হত্যা, হয়রানি-নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আসক এই তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে।

সংস্থাটির হিসাব বলছে, গত ১৫ বছরে ৩০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন গণমাধ্যমের স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতেন। সর্বশেষ ১৪ জুন রাতে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি গোলাম রব্বানিকে।

বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলমের নেতৃত্বে সাংবাদিক রব্বানিকে খুন করা হয়। তিনি গতকাল আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ব্যাপকভাবে আলোচিত এই খুনের ঘটনায় মাহমুদুল আলমসহ ছয়জনকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

সাংবাদিক খুনের মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিক গোলাম রব্বানি খুনের মামলার তদন্ত যে মুহূর্তে শেষ হবে, তখনই এই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। আর অন্য মামলাগুলো কী অবস্থায় আছে, সেই তালিকা পাওয়া গেলে বোঝা যাবে। মামলার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। 

দেশে সাংবাদিক হত্যার তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের (সাগর–রুনি) তদন্ত ১১ বছরেও শেষ হয়নি।

আসামিরা প্রভাবশালী, ছয় বছরেও বিচার শুরু হয়নি

২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে সমকাল–এর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম খুন হন। এ মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় ছয় বছরেও বিচার শুরু হয়নি বলে অভিযোগ আছে। মামলার প্রধান আসামি শাহজাদপুর পৌরসভার তৎকালীন মেয়র হালিমুল হক। তিনি তখন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে বহিষ্কৃত হন। 

এই মামলায় ২০১৭ সালের ২ মে হালিমুলসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন হালিমুলের দুই ভাই ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী। তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ হলেও ছয় বছর পরও বিচার শুরু করা যায়নি।

বাদীর আইনজীবী আবুল কাশেম মিয়া প্রথম আলোকে জানান, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ হত্যা মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যায়। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের জন্য পাঁচবার শুনানির তারিখ ধার্য করলেও আসামিপক্ষ সময়ের প্রার্থনা করে যাচ্ছে। ফলে এখনো অভিযোগ গঠন হয়নি।

সব আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা অসহায়ের মতো দেখছি।
নুরুন্নাহার খাতুন, নিহত সাংবাদিক আবদুল হাকিমের স্ত্রী

এত দিনেও মামলাটির বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন আবদুল হাকিমের স্ত্রী নুরুন্নাহার খাতুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা অসহায়ের মতো দেখছি।’ 

জামিনে আসামিরা, উদ্বেগে ভুক্তভোগী পরিবার

গত বছরের এপ্রিলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় কুমিল্লার ডাক পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক মহিউদ্দিন সরকারকে। এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত চার আসামি জামিনে আছেন। মহিউদ্দিনের পরিবার বলছে, মামলায় অভিযোগপত্র দিলেও বিচার শুরু হয়নি। আসামিরা জামিনে থাকায় তাঁরা উদ্বেগে আছেন।

দৈনিক কুষ্টিয়ার খবর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হাসিবুর রহমান খুন হন গত বছরের জুনে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া তিন আসামিই এখন জামিনে মুক্ত। এক বছরেও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি। হাসিবুরের পরিবার এখন বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে।

গত বছরের ৫ জুন খুন হন পটুয়াখালীর সাংবাদিক আবু জাফর। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রতিনিধি ছিলেন। জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে তিনি খুন হন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় একজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। 

তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা চলছেই

দেশে সাংবাদিক হত্যার তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের (সাগর–রুনি) তদন্ত ১১ বছরেও শেষ হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালত থেকে এ পর্যন্ত ৯৯ বার সময় নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মামলাটির প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ছিল। 

তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার আরেক উদাহরণ নোয়াখালীর সাংবাদিক বুরহান ‍উদ্দিন মুজাক্কির হত্যা মামলা। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই জেলার কোম্পানীগঞ্জের চাপরাশিরহাটে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বুরহান ‍উদ্দিন। তিনি দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার নামের একটি পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি। মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের নোয়াখালীর বিশেষ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান মুন্সির গৎবাঁধা উত্তর ‘তদন্ত চলমান’।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস–সিপিজের ‘গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স-২০২১’ (দায়মুক্তি সূচক) বলছে, বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। 

২০১৪ সালের ২০ মে রাতে যশোরের নীলমণিগঞ্জের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার সাংবাদিক সদরুল আলমকে। ৯ বছরেও এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। যশোরের গ্রামের কাগজ–এর সাংবাদিক জামাল উদ্দীন খুন হন ২০১২ সালের ১৫ জুন। ১১ বছর পরও বিচারকাজ শেষ হয়নি।

জামাল উদ্দীনের একমাত্র ছেলে তন্ময় ইসলাম এখন মালয়েশিয়া থাকেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মাদক চক্র নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণে তাঁর বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। খুনিরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ৪০ লাখ মামলার বিচার ঝুলে আছে। প্রক্রিয়াগত কারণে এই দীর্ঘসূত্রতা। সাংবাদিক হত্যার বিচারকাজ একই কারণে বিলম্বিত হয়।

ধামরাইয়ের সাংবাদিক জুলহাস উদ্দিনের হত্যার বিচার চেয়ে তাঁর মায়ের আকুতি প্রসঙ্গে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘৮০ বছরের একজন নারী ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবেন কি না, এমন আকুতি পীড়াদায়ক। সবার তো চাওয়া একটাই, হত্যার ঘটনাগুলোর সঠিক বিচার হোক, তদন্ত হোক।’ 

রায়ে পরিবারের অসন্তুষ্টি

২০০২ সালের ২ মার্চ খুলনায় দৈনিক পূর্বাঞ্চল–এর প্রতিবেদক হারুন-অর রশীদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। চার বছর পর ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে অভিযুক্ত ১৩ আসামির সবাই খালাস পান।  

হারুন-অর-রশীদের একমাত্র ছেলে সাগর ইকবাল গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীরা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন। তাঁদের নাম অভিযোগপত্রেই আসেনি। আবার অনেকের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ পড়ে গেছে। তাই রায়ের পর আমরা আর উচ্চ আদালতে যাইনি।’

এর আগে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে খুন হন দৈনিক অনির্বাণ–এর খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি নহর আলী। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উত্থাপন করতে পারেনি। ২০০৪ সালে আদালতের রায়ে সব আসামি খালাস পান।

খুলনায় ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদ–এর সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর আদালত ১১ আসামির ৯ জনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন। এই রায়ে খুলনার সাংবাদিক সমাজ ও নিহত ব্যক্তির পরিবার—কেউই সন্তুষ্ট ছিল না। মানিক সাহার ভাই প্রদীপ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বাদী ছিল রাষ্ট্র। নিরাপত্তার কারণে পরিবারের কেউ মামলার বাদী হননি। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীসহ হত্যার নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কারও নাম তদন্তে উঠে আসেনি। এ কারণে রায় নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

সাংবাদিক গোলাম রব্বানি খুনের মামলার তদন্ত যে মুহূর্তে শেষ হবে, তখনই এই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। আর অন্য মামলাগুলো কী অবস্থায় আছে, সেই তালিকা পাওয়া গেলে বোঝা যাবে। মামলার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। 
আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী

২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনার দৈনিক জন্মভূমি সম্পাদক হুমায়ুন কবিরকে (বালু) নিজ কার্যালয়ের সামনে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০৮ সালে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির হত্যা মামলার রায় দেন আদালত। রায়ে সাত আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা আরেকটি মামলায় পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। 

‘যাদের পেছনে ক্ষমতা আছে, তারাই হত্যা-নির্যাতন করে’

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস–সিপিজের ‘গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স-২০২১’ (দায়মুক্তি সূচক) বলছে, বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। 

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলের মতে, ‘যাদের পেছনে ক্ষমতা আছে, তারাই সাংবাদিকদের ওপর আঘাত হানে। তারা মনে করে, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না।’ তিনি বলেন, বিচার না হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো দীর্ঘ সময় ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা থাকে না নিহত সাংবাদিকের পরিবারের। আবার বাদীপক্ষ দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদনও আসামির পক্ষে চলে যায়।

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, এখন সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা দিতে হবে, সাংবাদিক হত্যা হলে বিচার হবে। সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন-হত্যার পেছনে যেসব প্রভাবশালী রয়েছে, তাদেরও বার্তা দিতে হবে—অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। খুনের শিকার সাংবাদিক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, ওই প্রতিষ্ঠানকেও আইনি লড়াইয়ে সব ধরনের সহায়তার দায়িত্ব নিতে হবে। 

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা]