সাংবাদিকের মোটরসাইকেলের কী অপরাধ?

নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রে বলা হয়েছে, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত ও অনুমোদনসূচক স্টিকারযুক্ত যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু মোটরসাইকেল ব্যবহারের জন্য কোনো স্টিকার ইস্যু করা হবে না
ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রায়ই বলে থাকেন সাংবাদিকেরা হলেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘চোখ ও কান’। সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের সুবিধার্থে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একটি ধারা যুক্ত করার জন্য গত সেপ্টেম্বরে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল ইসি। সেখানে তারা নির্বাচনের সময় সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা দিলে সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল ও জরিমানা করার প্রস্তাব করে। সেটি এখনো প্রস্তাব আকারেই আছে।

একদিকে ইসি যখন সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধের শাস্তির বিধান নির্বাচনী আইনে সংযোজন করতে চাইছে, তখন আবার সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ভোটের খবর সংগ্রহে সাংবাদিকদের কাজে পরোক্ষভাবে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের করণীয় নিয়ে একটি পরিপত্র জারি করে ইসি সচিবালয়। সেখানে ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ইসির নির্দেশনা পালন না করলে বা তার ব্যত্যয় ঘটালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরিপত্রে বলা হয়েছিল, সাংবাদিকেরা ভোটকেন্দ্রে ১০ মিনিটের বেশি সময় অবস্থান করতে পারবেন না। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়ার মুখে পরিপত্রটি আজ সকালে সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্র নয় সাংবাদিকেরা ভোটকক্ষে ১০ মিনিটের বেশি সময় থাকতে পারবেন না।

কিন্তু এরপরও কয়েকটি নির্দেশনা নিয়ে সংবাদকর্মীদের মধ্যে আপত্তি ও ক্ষোভ আছে। এর একটি হলো, একসঙ্গে একাধিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক একই ভোট কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। এখন প্রশ্ন হলো, যদি কোনো ভোট কক্ষে অনিয়মের ঘটনা ঘটে, তাহলে কি একজন বাদে অন্য সাংবাদিকেরা সে ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে পারবেন না? সবাই কেন অনিয়মের ঘটনার ছবি বা ভিডিও ধারণ করতে পারবেন না?

ঢাকার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্র সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে বুথকক্ষে বিশৃঙ্খলার চিত্র ধরা পড়ে

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনসহ সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্রের বাইরে পরিবেশ থাকে শান্ত। কিন্তু ভোট কক্ষের ভেতরে ঘটে নানা অনিয়ম। বহিরাগত ব্যক্তিরা গোপন কক্ষে অবৈধভাবে অবস্থান করেন। ভোটারদের অনেকে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। ‘গোপন বুথের ডাকাতেরা’ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের বোতাম চেপে দেন। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এসব দেখেও চুপ থাকেন। কোনো ব্যবস্থা তো নেন-ই না; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অনিয়মের সঙ্গে তারাও সরাসরি জড়িত থাকেন। আর জড়িত থাকেন প্রার্থীর এজেন্টরা।

কমিশন তাদের নির্দেশনায় বলেছে, ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্ট বা ভোটারের সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে না। তার মানে কি কমিশন ভোট কক্ষে তাদের ‘চোখ-কান’ বন্ধ রাখতে চায়? ভোটকক্ষে অনিয়মের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য সাংবাদিকেরা কীভাবে নেবেন? এর মাধ্যমে কমিশন কি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অনিয়মে উৎসাহিত করছে?

কমিশন যে পরিপত্র জারি করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত ও অনুমোদনসূচক স্টিকারযুক্ত যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু মোটরসাইকেল ব্যবহারের জন্য কোনো স্টিকার ইস্যু করা হবে না। অর্থাৎ ভোটের দিন সংবাদ সংগ্রহের কাজে সংবাদকর্মীরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে পারবেন না। পরোক্ষভাবে সাংবাদিকদের এভাবে বাধা দেওয়ার কারণ কী? মোটরসাইকেলের কী অপরাধ?

ভোটের দিন সাংবাদিকেরা মোটরসাইকেল কেন ব্যবহার করতে পারবেন না, সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা ইসির পরিপত্রে বলা হয়নি। তবে এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও নির্বাচন কমিশন মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তারা বলেছিল, সংবাদ সংগ্রহের কাজে গাড়িতে ব্যবহারের জন্য সাংবাদিকদের স্টিকার দেওয়া হবে। কিন্তু সে স্টিকার লাগিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। এ নিয়ে সংবাদ কর্মীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। পরে নির্বাচন কমিশন বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। সেখানে কমিশনের যুক্তি ছিল, মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হওয়ার শঙ্কা থেকে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তখন সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ইসি কি এমন একটি নজির দেখাতে পারবে, যেখানে সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে? সেদিন ইসি এমন কোনো নজির দেখাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনে সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে সেই পুরোনো নিষেধাজ্ঞা কেন?