মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক দুর্নীতির অভিযোগ।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) স্বাভাবিক কাজকর্ম হচ্ছে না প্রায় ১০ দিন ধরে। মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক দুর্নীতির অভিযোগে চলছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, সমাবেশ। ইতিমধ্যেই মহাপরিচালক পদত্যাগ করেছেন। অন্যদের পদত্যাগ আর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে।
‘পিআইবির নির্যাতিত ও বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ’ ব্যানারে আন্দোলন করছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সব স্তরের কর্মীরা। তাঁদের দাবি, মহাপরিচালক ও তাঁর সহযোগীরা পিআইবিকে ‘ক্ষতবিক্ষত’ করে ফেলেছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড জালিয়াতি, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য ও নিচের স্তরের কর্মীদের পদোন্নতি দেওয়া, প্রতিবাদ করলে তাঁদের মানসিক নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। মহাপরিচালকের সহযোগীদের অপসারণ করে বিচার না করলে পিআইবিতে কাজের পরিবেশ ফিরবে না বলে দাবি বিক্ষুব্ধদের।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ ২০১৯ সালে চুক্তি ভিত্তিতে পিআইবিতে মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পরে চার দফায় তাঁর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত বৃহস্পতিবার বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রথম আলোকে জানান, মহাপরিচালকের দুর্নীতি ও অত্যাচারের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন চলতি দায়িত্বে থাকা পরিচালক (প্রশাসন) জাকির হোসেন। অন্যদের মধ্যে আছেন পরিচালক (প্রশিক্ষণ) কে এম সাখাওয়াত (তিনি প্রেষণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কাজ করতেন), প্রটোকল কর্মকর্তা মাসুন-এ হাসান (প্রেষণে বিটিভিতে) ও হিসাবরক্ষক আলী হোসেন। এই প্রতিবেদকের কাছে অন্তত ১২ জন ভুক্তভোগী তাঁদের ওপর চালানো অন্যায়–অত্যাচারের বর্ণনা দেন।
তবে অভিযোগের জবাবে জাফর ওয়াজেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগের মহাপরিচালক রেজওয়ান সিদ্দিকীর আমলে বিএনপি-জামায়াতের অনেক অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগ রয়েছে। অনেকে দণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁরাই সুযোগ পেয়ে মিথ্যা অভিযোগে আন্দোলন করছেন। তিনি আরও বলেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ তছরুপ করা যায় না। আগে যে ব্যাংকে হিসাব ছিল, সেই ব্যাংক পরিবর্তন করে অন্য ব্যাংকে সরানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে সঠিক চাকরিবিধি নেই। এগুলো তিনি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। পরিচালনা বোর্ডে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য পরিচালনা বোর্ডের কিছু সদস্যও তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন।
এককথায় বলতে গেলে মহাপরিচালক এ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের প্রথম দিন থেকে পদত্যাগের দিন পর্যন্ত একটি দিনেও নিয়মের মধ্যে কোনো কিছু করেননি। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে তিনি ক্লাসলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।মধুসূদন মণ্ডল, সদ্য বিদায়ী সদস্য, পরিচালনা পর্ষদ, পিআইবি
জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগের পর আন্দোলন করে তারা আমার অফিসকক্ষ ভেঙে লুটপাট করেছে। বইপত্র নষ্ট করেছে। যে প্রশাসনিক পরিচালকের বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করছে, তিনি ৩০ বছর ধরে পিআইবিতে কাজ করেন। তিনি অনেকের দুর্নীতি, অপরাধের বিষয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করেছেন। এ কারণে কিছু লোক তাঁর ওপরে অসন্তুষ্ট হয়ে এসব অভিযোগ করছে।’
বিক্ষুব্ধ কর্মীদের মধ্যে প্রশিক্ষক পারভীন সুলতানা রাব্বী, শাহ আলম, জ্যেষ্ঠ গবেষক কামরুন নাহার, সহকারী হিসাবরক্ষক মিজানুর রহমান সরকারসহ অনেকেই প্রথম আলোর কাছে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ তাঁর প্রধান সহযোগী নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হাসানকে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি এবং একই সঙ্গে পরিচালক (প্রশাসন) পদে চলতি দায়িত্ব দিয়েছেন। নিয়ম ভেঙে মহাপরিচালক শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য জাকির হোসেনের নাম প্রস্তাব করে নিজেই অনুমোদন দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। এখতিয়ার না থাকলেও মহাপরিচালক বিধিমালা অমান্য করে বিভিন্ন পদে অন্তত ২৫ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁদের কাউকে কাউকে এমন পদে পদায়ন করা হয়েছে, যার নির্ধারিত যোগ্যতা তাঁদের নেই। অথচ আগের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের চাকরি স্থায়ী করার জন্য পরীক্ষা নেওয়া হলেও তার ফল প্রকাশ করা হয়নি।
পারভীন সুলতানা বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে একই পদে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবাদ করায় মহাপরিচালক তাঁকে ডিঙিয়ে নিচের গ্রেডের কর্মীকে তাঁর ওপরের পদে দায়িত্ব দিয়েছেন।
পাঠাগার সহকারী নিজাম উদ্দিন জানান, তাঁকে মালির কাজ দেওয়া হয়েছে। আর যিনি মালির পদে ছিলেন, বইপুস্তক সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে পাঠাগারে কাজ করতে পাঠানো হয়েছে। একই ভাবে আলোকচিত্রী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে এক মাছ ব্যবসায়ীকে বিধিবহির্ভূতভাবে আলোকচিত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ডেসপাস রাইডার তাজুল ইসলাম জানান, ‘ডিজি ও তাঁর সহযোগী জাকির হোসেন এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাঁদের চাকরি নাই।’ তিনি অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করতেন। প্রতিবাদ করায় তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি ২০১৬ সাল থেকে কাজ করছিলেন এবং চাকরি স্থায়ীকরণের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। একইভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অফিস সহায়ক জাকির হোসেন ও মো. কিবরিয়াকে।
পিআইবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে এখন লোকবল প্রায় ১০২ জন। এর মধ্যে গত ৬ বছরে ২৫ জনকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে মহাপরিচালক নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী ফরিদা ইয়াসমিন অভিযোগ করেন, তিনি ২০০৯ সাল থেকে অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন। তাঁর চাকরি স্থায়ী করা হবে বলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু স্থায়ী করা হয়নি। স্থায়ী করার কথা বললে তাঁকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে অন্যতম সহকারী হিসাবরক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, কাকরাইলের পূবালী ব্যাংক শাখায় পিআইবির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের হিসাব রয়েছে। ঘটনাক্রমে তিনি ২০২০-২১ বছরের হিসাব বিবরণীতে দেখতে পান যে অ্যাকাউন্ট থেকে সুদ বাবদ জমা হওয়া অর্থ যথাযথভাবে জমা হয়নি। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ তছরুপের বিষয়টি জানতে পারেন। কর্মচারীরা বিষয়টি জেনে গেলে তাঁরা নিজেদের জমার পরিমাণ জানতে চাইলে মহাপরিচালক তা জানানো বন্ধ করে দেন। সাজা হিসেবে মিজানুর রহমানকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে নিচের গ্রেডে গবেষণা শাখায় পদায়ন করেন। আর নিচের পদ থেকে হিসাবসংক্রান্ত ধারণা না থাকলেও একজনকে এই পদে পদায়ন করা হয়। উপরন্তু তাঁকে ৮০২ নম্বর কক্ষে ডেকে এনে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। অন্তত ১২ জন ভুক্তভোগী এই কক্ষে হেনস্তা–লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার বিবরণ দেন।
বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, মহাপরিচালক ও এই চক্রের বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়ে তাঁরা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তাতে আমল না দিয়ে বারবার মহাপরিচালকের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে।
পিআইবির চারটি বিভাগ—প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশাসন। প্রশিক্ষণ বিভাগে এখানে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তিন দিনের স্বল্প মেয়াদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০০০ সাল থেকে ছয় মাসের ডিপ্লোমা ও ২০১৯ থেকে এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। এই দুটি কোর্সই বহুদিন থেকে অনিয়মিত। কর্মকর্তাদের ভাষায় এগুলো ‘মুখ থুবড়ে পড়েছে’। ডিজি বাইরে থেকে তাঁর পছন্দের লোকদের এনে এসব কোর্স চালিয়েছেন।
গবেষণা আর প্রকাশনা নামমাত্র। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো ‘কাটপেস্ট’ করে গবেষণার কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ।
প্রকাশনার হালও একই রকম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় একই ধরনের লেখা ওলটপালট করে কিছু বই প্রকাশ করা হয়েছে। নিরীক্ষা নামের যে ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেটি কার্যত বঙ্গবন্ধু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের গুণকীর্তনের পুস্তিকা। অভিযোগকারীদের ভাষায় ‘এর লেখাগুলো তেলসর্বস্ব’। সহকারী সম্পাদক শাহেলা আক্তার ও মিজানুর রহমান জানান, তাঁরা প্রশিক্ষণ বিভাগের পাঠ্যক্রমের জন্য বাংলা ও ইংরেজিতে দুটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়নি।
পিআইবির মহাপরিচালক ও তাঁর অনুগত চক্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালনা পর্ষদের সদ্য বিদায়ী সদস্য বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার নগর সম্পাদক মধুসূদন মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, এককথায় বলতে গেলে মহাপরিচালক এ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের প্রথম দিন থেকে পদত্যাগের দিন পর্যন্ত একটি দিনেও নিয়মের মধ্যে কোনো কিছু করেননি। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে তিনি ক্লাসলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। জাকির হোসেন নামের যে কর্মকর্তাকে নিয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না বলে আগের পরিচালনা পর্ষদের মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু মহাপরিচালক সেই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে বারবার পদোন্নতি দিয়েছেন। তাঁরা অন্তত ২৪ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে পরিচালনা পর্ষদও পরিবর্তন করেছেন।