‘মেয়েকে আইসিইউতে নেওয়া মানেই ছিল মেয়ে বাড়ি ফিরতেও পারে, নাও ফিরতে পারে। তবে এখন সবার দোয়ায় মেয়ে ভালো আছে। স্কুলে যাচ্ছে।’—কথাগুলো বললেন ফাইজা আনবার আমিরার বাবা মুশফিকুর রহমান।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার (ইংরেজি ভার্সন) প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাইজা ডেঙ্গুতে মুমূর্ষু অবস্থায় ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিল। গত ১২ জুলাই ফেসবুকে স্কুলের গ্রুপে ফাইজার জন্য সবার কাছে দোয়া চাওয়া হয়। ১৭ জুলাই স্কুলের গ্রুপেই জানানো হয়, ফাইজা সবার দোয়ায় বাড়ি ফিরেছে।
রাজধানী ঢাকার শহীদবাগের বাসিন্দা মুশফিকুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী। জানালেন, প্রথমে মেয়ে ফাইজাকে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চার দিন আইসিইউসহ খরচ হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই বাবা বলেন, ‘মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। মনে হয়েছে, যত টাকা লাগে লাগুক, আগে মেয়ের জীবন। তবে হুট করে এতগুলো টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম তো খেতেই হয়েছে।’ তাঁর চার বছর বয়সী আরেকটি ছেলে আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৯১। তবে কত শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে, সে ধরনের কোনো পরিসংখ্যান নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাবা-মায়েরা স্বজন ও বন্ধুদের জন্য সন্তানের হাসিমুখের ছবি দিয়ে শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা পিআইসিইউ) ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে বাড়ি ফেরার খবর জানাচ্ছেন। চারপাশে ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর খবরে এই হাসিমুখের ছবিগুলোয় কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসছে। তবে চিকিৎসায় লাগামহীন খরচে পরিবারগুলো দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সন্তানকে নিয়ে শিশুদের পিআইসিইউ বা বড়দের আইসিইউতে কাটানো দিনগুলো মা-বাবা এমনকি শিশুরাও ভুলতে পারছে না। নানা মানসিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
শিশুসাহিত্যিক জ্যোৎস্না লিপি গত ২৪ আগস্ট তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই হাসিটি দেখার জন্যই এত অপেক্ষা। প্রকৃতিকে বাসায় নিয়ে এসেছি...।’
গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া প্রকৃতি ও নিসর্গ নামের দুই যমজ সন্তানের মা জ্যোৎস্না লিপি। তাঁর স্বামী বিপ্লব হালদার ইউনাইটেড হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট। ডেঙ্গুতে প্রকৃতি ভর্তি ছিল সেগুনবাগিচায় বারডেম জেনারেল হাসপাতাল-২ (মা ও শিশু)-এ।
ফেসবুকের দিনলিপিতে জ্যোৎস্না লিপি এর আগে গত ১৮ জুলাই লিখেছিলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাসকে হারিয়ে জয়ী হয়ে প্রকৃতি বাসায় ফিরেছে।’ সেবার ছিল ১০ দিনের যুদ্ধ। ৯ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল প্রকৃতি। তবে সেবার তার আইসিইউ লাগেনি। এক মাসের ব্যবধানে প্রকৃতির আবার ডেঙ্গু হয়। গত ২০ আগস্ট এই মা লিখেছেন, ‘আমি প্রকৃতিকে নিয়ে আইসিইউতে আছি। আবার ডেঙ্গু...’, ‘মেয়ে যখন আইসিইউতে, তখন ছেলে নিসর্গের জ্বর হলে তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়’, ‘মেয়ের রক্ত লাগবে’, ‘আইসিইউতে প্রকৃতির শারীরিক পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে...’, ‘প্রকৃতিকে আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে...’, ফেসবুকের এ ধরনের ছোট ছোট লেখাতে আইসিইউর বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনেরা বুঝে নিতেন আইসিইউর ভেতরের সংগ্রামটা কোন মাত্রায় আছে।
জ্যোৎস্না লিপি মেয়ের চিকিৎসায় খরচ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইসিইউতে খরচ কত হবে, তার হিসাব করা মুশকিল। রাত আড়াইটার সময় এমন এক ইনজেকশনের কথা বলা হলো, যার দাম যেমন বেশি, রাতের বেলা তা পাওয়া যাবে কি না, তারও নিশ্চয়তা নেই। স্যালাইন কিনে আনতে হয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। ডাব কেনা থেকে শুরু করে সবটাতেই তো লাগামহীন খরচ। হাসপাতালের আইসিইউ, কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। দুই দফায় সব খরচ যোগ করলে খরচটি গিয়ে দাঁড়াবে ২ লাখ ৭০ হাজারের কাছাকাছি।’
জ্যোৎস্না লিপির মতো গণমাধ্যমকর্মী ইশরাত জাহান ঊর্মিও তাঁর মেয়ে নহলী ঊষশী খানকে নিয়ে সংগ্রামের অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে লিখে রেখেছেন। অন্য বাবা-মায়েদের যদি কাজে লাগে, তাই ভেবেই এসব লেখা বলে জানিয়েছেন তিনি। গত ২৬ আগস্ট নহলী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। নহলী ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি ছিল। চিকিৎসায় খরচ হয়েছে পৌনে দুই লাখ টাকা।
ইশরাত জাহান ঊর্মি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ডেঙ্গু যে এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, শুরুতে তা তেমন গুরুত্বই দিইনি। এক চিকিৎসক মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য তাড়া না দিলে হয়তো এত দিনে মেয়েকে হারিয়েই ফেলতাম। এবারের ডেঙ্গু তো একেবারেই সময় দিচ্ছে না।’
ইশরাত জাহান ঊর্মি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আইসিইউতে বাচ্চা রাখা আর সুতার ওপর হাঁটা এক জিনিস।’ সন্তানের ডেঙ্গু হলে প্রচুর তরল খাবার খাওয়ানো, পেট ব্যথা বা বমি হলে কোনো মা-বাবা যাতে সন্তানকে হাসপাতালে ভর্তি করতে এক মিনিট সময়ও নষ্ট না করেন, তাই বারবার অনুরোধ করেছেন। ১১ বছর বয়সী নহলী পড়ছে ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে।
রাজধানীর পান্থপথে বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডের (আইসিইউ ও ইমার্জেন্সি) কনসালট্যান্ট আশরাফ জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ডেঙ্গু মৌসুমে যেসব মা-বাবা সন্তানের বিষয়ে সচেতন ছিলেন, সন্তানের জ্বর আসার পর বাসায় সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে এসেছেন, সেসব মা-বাবা হাসিমুখে সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এই চিকিৎসক জানালেন, এবারের ডেঙ্গুতে, বিশেষ করে শিশুদের বেলায় চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। হাসপাতালগুলোয় শিশুদের পিআইসিইউয়ের সংখ্যা কম। শিশুর অবস্থা জটিল হলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরে সময় নষ্ট না করে বড়দের আইসিইউতে রেখেই যদি বিশেষভাবে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া যায়, তা অনেক কাজে লাগে।
গুলশানে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এস এম ওয়ায়েস করনী। তাঁর স্ত্রী নুসরাত জাহান গৃহিণী। আট বছর বয়সী ছেলে সাহিল রাফায়ানকে নিয়ে ডেঙ্গুযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন এই মা-বাবা। গত ১৮ আগস্ট ছেলে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ৫ দিন আইসিইউসহ মোট ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।
রামপুরার বাসিন্দা এস এম ওয়ায়েস করনী জানালেন, তাঁদের ছয় বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে আছে। একই দিনে ছেলে ও তাঁর নিজের জ্বর আসে। তবে রক্তের পরীক্ষায় ছেলের ডেঙ্গু পজিটিভ এলেও তাঁরটা নেগেটিভ আসে। ছেলের জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট উঠে গেলে তাকে প্রথমে মিরপুরের শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কেননা আত্মীয়দের অনেকেই মিরপুরে থাকেন। তবে প্লাটিলেট, হিমোগ্লোবিন কমতে থাকলে ওই হাসপাতাল থেকেই পিআইসিইউ আছে, এমন হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তির জন্য বলা হয়। পরে হেলথ অ্যান্ড হোপের আইসিইউতে ছেলেকে ভর্তি করা হয়। দুই হাসপাতাল মিলে ছেলের চিকিৎসায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়।
এস এম ওয়ায়েস করনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন যেখানে চাকরি করছি, সেখানে নতুন যোগ দিয়েছি। আমি নিজেও অসুস্থ। ছেলের জন্য নিজের দিকেও তাকাতে পারিনি। কত টাকা খরচ হবে, সে চিন্তা তো ছিলই। তারপরও তখন ভাবনা ছিল, যে করেই হোক ছেলেকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরতে হবে।’ এই বাবা জানালেন, কিছু টাকা নিজের ছিল, আর আত্মীয়স্বজনও পাশে ছিলেন।
মা ইলেন পেরেজা কস্তা আট বছর বয়সী ছেলে সাহিত্যকে নিয়ে যুদ্ধজয়ের গল্প শোনালেন। গত ২২ জুলাই স্কয়ার হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ২০১৯ সালেও ছেলের ডেঙ্গু হয়েছিল। তবে সেবার বাসায় তিন দিনেই ভালো হয়ে গিয়েছিল। আর এবার ছয় দিন, তাও আইসিইউ থেকে ঘুরে আসতে হলো। গত বছর ডেঙ্গুতে ১৩ বছর বয়সী এক কাকাতো ভাই মারা যায়। এবার তো চারপাশ থেকে শুধু শিশুদের মৃত্যুর খবর, তাই শুরু থেকেই আতঙ্কটা খুব বেশি মাত্রায় ছিল এই মায়ের।
ইলেন পেরেজা কস্তা বলেন, ‘ছেলের যখন নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়, আমি তখন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু বলেছি, ছেলের জীবন ছাড়া এই পৃথিবীতে আমি আর কিছু চাই না। একটাই ছেলে আমার। বাড়ি ফিরলেও রাতে এখনো ছেলে ভয় পায়, মা মা বলে জড়িয়ে ধরে।’
ইলেন পেরেজা কস্তা জানালেন, তাঁর স্বামী ব্যবসা করেন। তবে করোনায় ব্যবসাটা বলতে আর কিছু নেই। এখন ছেলের ডেঙ্গুতে আবার খরচের ধাক্কা। সব মিলে ৫৯ হাজার টাকা খরচ সামলাতেও হিমশিম খেতে হয়েছে।
নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশু, যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি, তাঁদের মা-বাবার কষ্ট আরও বেশি। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন শিশু ও তাদের পরিবারের আর্থিক কষ্ট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন।
আইসিইউ থেকে সন্তান নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেও খরচের ধাক্কায় পরিবারগুলো দিশাহারা হয়ে পড়েছে, এই প্রসঙ্গে বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডের (আইসিইউ ও ইমার্জেন্সি) কনসালট্যান্ট আশরাফ জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইসিইউতে গেলে খরচটা হুট করেই বেড়ে যায়। আর মানুষ বেড়ানো, পোশাক কেনাসহ বিভিন্ন খাতের জন্য টাকা জমালেও চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য কোনো টাকা জমায় না। বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। কেননা, জরুরি পরিস্থিতিতে জমি বিক্রি করতে হলেও কম টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যবিমার বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।’
আশরাফ জুয়েল বলেন, বাড়ি ফেরার পর শিশুদের টানা বিশ্রামে রাখতে হবে। পুষ্টিকর ও তরলজাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরার পরও শিশুরা একধরনের ট্রমার মধ্যে থাকে। তাদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেও মা-বাবা ও শিশুদের কাউন্সেলিং করা জরুরি।