দেশে সব ধরনের মোটা চালের দাম আরেক দফা বেড়েছে। মধ্যবিত্তের পছন্দের মাঝারি চালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২ থেকে ৩ টাকা (প্রায় ৮ শতাংশ) বেড়েছে। মোটা ও সরু চালের দাম বেড়েছে ২ টাকা (প্রায় ৭ শতাংশ)। তাই খাদ্য অধিদপ্তর ও টিসিবির ন্যায্যমূল্যের দোকানে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বেশির ভাগ এলাকায় কম দামে খাদ্যপণ্য কিনতে মানুষের ভিড় বাড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগছেন। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মানুষ বিপদে থাকতে পারেন। তাদের মধ্যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া তিন লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছে। এ অবস্থায় তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১৬ লাখ মানুষের জন্য জরুরি খাদ্যসহায়তা দরকার।
রাজধানীর পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বেশির ভাগ এলাকায় কম দামে খাদ্যপণ্য কিনতে মানুষের ভিড় বাড়ছে।
জাতিসংঘসহ বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে এই জরিপ করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দুই বছর ধরে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ও কৃষি উপকরণের বিষয়টিকে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এখন পর্যন্ত চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি চালকলমালিক, ব্যবসায়ী, খাদ্যপণ্যের আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কোনো সভা হয়নি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার অভাব ও বিগত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়ীরা নিষ্ক্রিয় থাকায় দাম হঠাৎ বাড়ছে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
প্রতিবেদনে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের ভৌগোলিক অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন।
জরিপে দেখা গেছে, ১৬ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের জরুরি খাদ্যসহায়তা দরকার। খাদ্য নিয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন ২ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ। আর ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ চাপে আছেন। শুধু ৩ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার মধ্যে খাদ্য পরিস্থিতিকে আশ্চর্যজনকভাবে কম গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। সরকার পণ্য সরবরাহ ও খাদ্য বণ্টনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে না পারলে সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের জন্য খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আসন্ন বোরো–রবি মৌসুমে বিনা মূল্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়া দরকার। শুধু রিজার্ভের উন্নতি হলেই অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। বিগত সরকারের অলিগার্কদের হাতে দেশের খাদ্যপণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা কুক্ষিগত ছিল। এর দ্রুত পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে গত এপ্রিলে একই জরিপে দেশের ৩৩টি অঞ্চলের মধ্যে ২০টি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত মে মাস থেকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মারাত্মক দুর্যোগ আঘাত হানে। তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে শুরু করে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল, জুনে হাওরে আকস্মিক বন্যা, জুলাইয়ে যমুনা তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ বন্যা ও আগস্টে দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছর এসব দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাঁদের বড় অংশই কৃষিজীবী। এঁদের আবার এক–চতুর্থাংশ কৃষিমজুর। দুর্যোগ ও তাপপ্রবাহের কারণে তাঁরা ঠিকমতো কাজ পাননি। কাজ পেলেও মজুরি পেয়েছেন কম। এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শুধু কৃষি মজুরি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমাতে হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে ফসল, গবাদিপশু, মৎস্য সম্পদ এবং মজুত খাদ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। বছরের বাকি সময়ে দেশে আরও দুর্যোগ দেখা দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। এতে খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে এবং গৃহস্থের আয় কমে আসতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছর এসব দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাঁদের বড় অংশই কৃষিজীবী। এঁদের আবার এক–চতুর্থাংশ কৃষিমজুর। দুর্যোগ ও তাপপ্রবাহের কারণে তাঁরা ঠিকমতো কাজ পাননি। কাজ পেলেও মজুরি পেয়েছেন কম।
বাংলাদেশে গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম ব্যহত হয়। বিশেষ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে। ওই অভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। কিন্তু আগের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোর তেমন পরিবর্তন হয়নি।
নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ
অর্থনৈতিক চাপের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের মানুষের আয় কমে গেছে এবং ব্যয় বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাতের কারণে ওই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। আমদানি–রপ্তানি ও বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলেন, সাধারণত বোরো মৌসুম শুরুর আগের দুই মাস দেশে চালের দাম বেশি থাকে। এ সময় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা বাড়াতে হয়। এবার নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।