পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ১৯৭১
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ১৯৭১

টেলিগ্রামে গণহত্যার ভয়ংকর চিত্র, ওয়াশিংটন নির্বিকার

১৯৭১ সালে আর্চার কে ব্লাড ছিলেন ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের তিনি নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী। বাংলাদেশ থেকে আর্চার ব্লাড যেসব তারবার্তা পাঠান, তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অবস্থানের বিরোধী। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর বই দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেসোয়ার্স অব অ্যান আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট জন্ম দেয় প্রখ্যাত ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ শব্দবন্ধটি। সে বই প্রকাশের তিন বছর আগে এর অংশবিশেষের অনুবাদ প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।

দলিল

আমরা পররাষ্ট্র দপ্তরের লোকজন কোনো টেলিগ্রাম পাঠানোর সময় একটা শিরোনাম দিয়ে দিতাম। যেমন ধরুন মুজিবের সঙ্গে বৈঠক। এর ফলে যাদের দৈনিক কয়েক শ টেলিগ্রাম নাড়াচাড়া করতে হয়, তাদের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারবার্তাটি বেছে নিতে সুবিধা হতো। আর বেশির ভাগ শিরোনাম থাকত সরাসরি বর্ণনাত্মক। তবে কখনো কখনো আমরা দৃষ্টি আকর্ষক শিরোনামও দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

মার্চের ২৮ তারিখে আমি ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ শিরোনাম দিয়ে একটা টেলিগ্রাম পাঠালাম। যত দূর জানি, এ ধরনের শিরোনামের ব্যবহার এই প্রথম। তবে এটাই শেষ নয়। হতাশা আর ক্রোধ থেকেই এই বার্তা পাঠালাম। তিন দিন ধরে আমরা ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনে নৃশংস সেনা হামলার সচিত্র রিপোর্ট পাঠিয়ে সয়লাব করে ফেললাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এই প্রতিক্রিয়াহীন পরিবেশে এই বিষয়টি নিয়ে গলা ফাটিয়ে আমিও রেগে বোবা হয়ে পড়লাম এবং ঠিক করলাম, আমাদের এই ব্যাপক রিপোর্ট লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন না করা পর্যন্ত অবস্থার ভয়াবহতা আরও যথার্থ মাত্রায় পরিবেশন করব। সেই বিপুল পরিমাণ টেলিগ্রামের কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত করা হলো:

১. ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, আমরা তার নীরব ও আতঙ্কগ্রস্ত সাক্ষী। মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের কাছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটা তালিকা আছে। সেই তালিকা ধরে ধরে তাঁদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে গুলি করে সুচারুভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আর এর সপক্ষে তথ্য–প্রমাণও ক্রমশ বাড়ছে। 

২. পাকিস্তানি বাহিনীর এই খতম তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, ছাত্রনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নাম আছে; আছে বহু জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য (এমএনএ) এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের (এমপিএ) নাম।

৩. এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের মদদে অবাঙালি মুসলিমরা নিয়ম করে দরিদ্র লোকজনের বাড়িঘর আক্রমণ করছে এবং খুন করছে বাঙালি ও হিন্দুদের। ঢাকার রাস্তাগুলোতে হিন্দু আর ঢাকা ছেড়ে যেতে ব্যস্ত অন্য লোকজনে ভর্তি। অনেক বাঙালি মার্কিনদের বাড়িঘরে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং তাদের বেশির ভাগকে আশ্রয়ও দেওয়া হয়েছে।

৪. কারফিউ আজ আরও জোরদার করা হয়েছে (দুপুর থেকে কারফিউ পুনরায় জারি হয়েছে)। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনারা তাদের তল্লাশি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কাজ সহজতর করতেই কারফিউ জারি করেছে। অথচ ঢাকায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ নেই।

৫. পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র আজ হোক কাল হোক প্রকাশিত হবেই। সুতরাং পাকিস্তান সরকারের (জিওপি) মিথ্যা দাবি মেনে নেওয়ার ভান করা এবং এই অফিস থেকে বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর পরেও পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বুঝতে অস্বীকৃতি জানানো বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যুক্তিগ্রাহ্য মনোভাব নিয়ে, অতঃপর আমি প্রশ্ন তুলি। নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, সে ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে গোপনে হলেও আমাদের মর্মাহত হওয়ার কথা জানানো উচিত। তাহলে অবশ্য আমি নিজে একটা তথ্যসূত্র হিসেবে চিহ্নিত হতে পারি এবং পাকিস্তান সরকার দ্বিধাহীনচিত্তে আমাকে সে দেশ ত্যাগ করতে বলবে। আমি মনে করি না তাতে এখানকার মার্কিনদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে, শুধু আমাদের তথ্য সরবরাহে কিছু বিপত্তি আসতে পারে।

আর্চার কে ব্লাড

এই বার্তার কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাল না ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস। ওয়াশিংটন থেকে পররাষ্ট্র দপ্তরের পাকিস্তানবিষয়ক কান্ট্রি ডিরেক্টর আমাকে জানালেন, তিনি বুঝতে পারছেন, ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিনরা তাঁদের বাড়িতে পূর্ব পাকিস্তানিদের আশ্রয় দিতে পারেন। তিনি এমন ‘বিপজ্জনক’ কাজকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন। উত্তেজিত অবস্থায় আমি তাৎক্ষণিকভাবে একটা উত্তর দিলাম। বললাম, ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি মার্কিন নাগরিক তাঁদের কাজের লোকের ঘরে বহু ভীত ও সন্ত্রস্ত্র হিন্দু-মুসলিম বাঙালিদের আশ্রয় দিচ্ছেন। আমি যত দূর জানি, এই আশ্রিতরা হতদরিদ্র এবং রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের কোনো সংস্রব নেই। আমার নিজের কাজের লোকই বহু মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আমি এই বলে শেষ করলাম যে আমাদের কাজের লোকেরা মানবিক মমত্ববোধ ও নিজেদের ঝামেলার কথা চিন্তা করেও যে কাজ করেছে, তাকে নিরুৎসাহিত করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। এরপরে এ ব্যাপারে আর টুঁ শব্দটি শুনতে পাইনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওই সময় পাঠানো টেলিগ্রামগুলো, যার ওপর থেকে সম্প্রতি গোপনীয়তার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে, ১৯৯৯-এর জানুয়ারিতে খুঁজতে গিয়ে আমি আর পাইনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর একটা সিদ্ধান্ত ছিল, বেছে বেছে গণহত্যাসংক্রান্ত টেলিগ্রামগুলো ‘এক্সডিস’ লেবেল লাগিয়ে শুধু যাদের জানা প্রয়োজন তাদের পড়ানো। যদিও এ ধরনের ব্যবস্থা একেবারে নিশ্ছিদ্র ছিল না। কারণ, ওয়াশিংটনে তখন ঢাকা থেকে পাঠানো আমাদের টেলিগ্রামগুলো কারা যেন সংবাদমাধ্যম ও ক্যাপিটল হিলের কাছে ফাঁস করে দিচ্ছিল। এই ফাঁসের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনও অতিষ্ঠ ও জটিল হয়ে উঠল। কারণ জানা ওই লোকজন আমাদের ঢাকা থেকে পাঠানো রিপোর্টগুলো ঢালাওভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আর এ রিপোর্টগুলো যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিরক্তিকর ছিল, তা তো আমাদের জানা।

২ এপ্রিল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় এক রিপোর্টার বললেন, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ও ক্যাপিটল হিল থেকে পাওয়া সংবাদে বোঝা যাচ্ছে যে সরকার আমাদের ঢাকা কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস থেকে সেখানকার রক্তাক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। এমনকি ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ শব্দটি কূটনৈতিক পরিভাষায় ব্যবহার করা হয়েছে, তারও উল্লেখ করলেন তিনি। এবার সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন মুখপাত্রের দিকে, ‘আপনি বলুন এটা ঠিক কি ভুল? অথবা আপনি কি বলতে পারেন সরকার কেন এ বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম আলোচনা করতে চাইছে না।

এ ব্যাপারে মুখপাত্রটির জবাব ছিল শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সেরা উদাহরণ। তিনি বললেন, আমরা বারবার সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছি, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পাওয়াটা খুবই কঠিন, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের অবস্থা সম্পর্কে। যদিও সেসব জায়গার পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত বলেই আমরা জানি। পাকিস্তানের জনগণের জীবনহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও দুঃখ-কষ্টে আমরাও স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন। তবে সেখানে কী ঘটেছে, তা বলা এ মুহূর্তে আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

মার্চের ২৮ তারিখে আমি ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ শিরোনাম দিয়ে একটা টেলিগ্রাম পাঠালাম। যত দূর জানি, এ ধরনের শিরোনামের ব্যবহার এই প্রথম। তবে এটাই শেষ নয়।

‘বেছে বেছে গণহত্যা’ সংক্রান্ত টেলিগ্রামের আরেকটি জোরালো প্রতিক্রিয়া এল এবং এটি হলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একজনের কাছ থেকে। এই বার্তা পাওয়ার ঠিক পরদিন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং একটি জোরালো বার্তা পাঠালেন। বার্তাটি এরূপ—বিষয়: বেছে বেছে গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাদের পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালানোর ঘটনায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। এবং এ সম্ভাবনার কথা ভেবে আতঙ্কিত যে আমেরিকান অস্ত্র দিয়ে এহেন নৃশংসতা চালানো হচ্ছে। এই আধিপত্যবাদী সামরিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ক্ষতিকর অভিযোগ সম্পর্কে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত—১. এক্ষুনি জনসমক্ষে জোরালোভাবে এই নৃশংসতার নিন্দা করা। ২. গোপনে এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করা উচিত এবং ভারত সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত করা উচিত। ৩. উচিত এককালীন ব্যতিক্রমী সামরিক সরবরাহ চুক্তি বাতিল করা এবং ১৯৬৭-এর নিয়ন্ত্রিত নীতির অধীনে সব সামরিক সরবরাহ (যন্ত্রাংশ, প্রাণনাশক নয়, এমন অস্ত্র) স্থগিত রাখা। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এসব নিষ্ঠুর হত্যা অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রকাশিত হওয়ার আগেই এবং কমিউনিস্টরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার আগেই এসব ব্যবস্থা নেওয়া। এটা এমন একটা সময়, যখন নীতি মেনে চলাটাই সবচেয়ে ভালো রাজনীতি।

ঢাকায় কিটিংয়ের বার্তাটি পড়ে আমাদের মিশ্র অনুভূতি হলো। পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নিন্দা করতে বলে তিনি আমাদের প্রস্তাব অনুমোদন করায় আমরা তাঁর এই অনুমোদনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। পাকিস্তানকে সব রকম সামরিক সহায়তা বন্ধ রাখাসংক্রান্ত তাঁর প্রস্তাবটিও আমরা মেনে নিলাম। পাশাপাশি আমরা এ–ও জানতাম, তাঁর এই প্রস্তাবে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ক্ষুব্ধ হবেন। তিনি এটাকে তাঁর কাজে হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করবেন। কারণ, বিষয়টি নিয়ে ইসলামাবাদ দূতাবাসের মাথা ঘামানোর কথা। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিটিংয়ের এ কাজে খুশি হবে না। এখন দুই রাষ্ট্রদূতের এই দ্বন্দ্বে আমরা মহাসংকটে পড়ে গেলাম। কারণ, আমাদের রিপোর্ট, আমাদের সহানুভূতি, সবকিছু আমাদের রাষ্ট্রদূতের চেয়ে রাষ্ট্রদূত কিটিংয়ের কথার অনুকূলে ছিল।

আসন্ন দিন ও সপ্তাহগুলোতে গ্রামাঞ্চলে বাঙালিদের প্রতিরোধ বাড়ছিল এবং পরিস্থিতি একটা গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছিল। আমরা অনুভব করলাম, বাঙালি মুসলমানদের সব হত্যাকেই ‘গণহত্যা’ বলে বিশেষায়িত করাটা যথাযথ হবে না। লড়াই জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষই নৃশংসতা চালাচ্ছিল। যদিও বিনা উসকানিতে সেনাবাহিনীর গুলি চালানোর খবর আমরা কখনো পাচ্ছিলাম। তবে মনে হয়েছিল, গ্রামাঞ্চলে
নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করতে সামরিক উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী তার সহিংসতা আরও বাড়িয়ে চলেছে। অপর দিকে বেছে বেছে হিসাব করে হিন্দুদের ওপর নগ্ন হামলার বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ শব্দটি সবচেয়ে কার্যকর মনে হলো। এর পর থেকে আমাদের রিপোর্টে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি উল্লেখ করার সময় ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করলাম। 

‘বেছে বেছে গণহত্যা’, প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ১৯৯৯