কর্মীর লেখা

‘অমানবিক’ উপায়ে ‘মানবিক প্রতিবেদন’ লেখার অভিজ্ঞতা

প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আমি মানসুরা, প্রথম আলো থেকে বলছি। আপনার মেয়েটা তো ডেঙ্গুতে মারা গেছে’—মুঠোফোনের অন্য প্রান্ত থেকে তখন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কোনো মা বা বাবা কথা বলা শুরু করেন। কেউ সরাসরি বলেন, তিনি কথা বলতে চাইছেন না। বাসায় গিয়ে সরাসরি কথা বলা ও ভিডিও স্টোরি করার অনুমতি মেলে অনেকের কাছ থেকে।

পরিবারের সদস্য কোনো কারণে মারা গেলে ওই পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে বাবা বা মায়ের সঙ্গে প্রতিবেদনের জন্য কথা শুরু করাটাই একটা কঠিন কাজ। সদ্য সন্তান হারানো বাবা বা মায়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, এটা ভাবতে ভাবতে এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে দীর্ঘ সময় চলে যায়। এটা করি, ওটা গুছাই, ফোন হাতে নিয়েও রেখে দিই। তারপর একসময় দুরুদুরু বুকে ফোনটা করতেই হয়।

অনুমতি মিললে বাসায় যাওয়ার পর কথার ফাঁকে বলতে হয়, আপনার মেয়ে বা ছেলের ঘরটা একটু দেখি, মেয়ের পুতুলটা দেখি। ওহ, ছেলে মনে হয় ক্রিকেট খেলত। ছেলের হাতের লেখা তো অনেক সুন্দর ছিল। ততক্ষণে সন্তান হারানো বাবা মা মৃত সন্তানের স্মৃতিতে ডুবে গেছেন। আলগোছে কেউ ছেলের ক্রিকেট ব্যাটে হাত বুলিয়ে নেন। কেউ সন্তানের ছবিতে চুমু দিতে থাকেন। আর আমার মাথায় ঘুরতে থাকে, সাজ্জাদ ভাই বা জাকারিয়া ভিডিও করার সময় মায়ের চোখ দিয়ে যখন টপটপ করে পানি পড়ছিল, সেই দৃশ্য ক্লোজআপে নিয়েছেন তো?

জুলাই মাসের কথা। আহনাফ রাফান হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মুঠোফোনে কিছু একটা দেখছে—এমন একটা ছবি দিয়ে একজন ফেসবুকে পোস্টে জানিয়েছেন, আহনাফ রাফান ডেঙ্গুতে মারা গেছে। আহনাফের ছবিটা মাথায় খুব যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। অনেক কষ্টে আহনাফের বাবার মুঠোফোন নম্বরটা পেলাম। তারপর দুরুদুরু বুকে এই বাবাকে ফোন দেওয়ার পালা। বাবা মো. মনিরুজ্জামান টাঙ্গাইল থেকে ফোনটা ধরলেন। জানালেন, একটু পরেই ছেলের জানাজা।

ডেস্ক থেকে আজিজ হাসান আহনাফের গল্পটা শুনেই বলে রেখেছে—আপা, একটু দ্রুত নিউজটা দেন। বাবা ছেলের জানাজায় যাচ্ছেন, তখন এই বাবাকে কেমনে প্রশ্ন করি, এ নিয়ে আমার মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। তারপরও সাহস করে টুকটাক কথা বললাম। কেননা, জানাজা শুরু হলে এই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এই বাবা বললেন, ‘ছেলেটা মঙ্গলবারও হাসপাতালে হাসল, খেলল আর এখন তার জানাজা হবে।’

আগস্ট মাসে রাজধানীর পাইকপাড়ার মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে আরাফাত হোসেন রাউফ ও ইসনাত জাহান রাইদা নামের দুই ছেলে–মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন। এই বাবা শুরুতে কথা বলতে চাননি, তবে পরে জানালেন, বাসায় গেলে কথা বলবেন। বাসায় গিয়ে দেখা গেল, পুতুল, রংপেনসিল, বই-খাতা, ছোট ছোট জামা, জুতা—ঘরে সবই আছে, শুধু বাচ্চা দুটি নেই। বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। বাবার বড় বড় দীর্ঘশ্বাস আর আহাজারি। তারপর কথা শুরু হলো। আরাফাতের বয়স ছিল ৯ বছর আর রাইদার ছিল সাড়ে ৬ বছর।

সেপ্টেম্বর মাসের এক সকাল। ডেঙ্গুতে ছোট ছেলের লাশ হিমঘরে, আইসিইউতে থাকা বড় ছেলের কাছে তখনো হাসিমুখে যেতে হয়েছে মা শিমুল পারভিনকে। তিনি নিজেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। এই মা মুঠোফোনে কথা বলেই চলছেন। আমিও মুঠোফোন কানে দিয়ে শুনছি তো শুনছিই। মাকে থামাতে ইচ্ছা করল না। ঘণ্টাখানেক পর এই মা যখন ফোন রাখলেন, তখন দেখলাম একভাবে মুঠোফোন ধরে রাখতে রাখতে আমার হাত ঝিঁঝিঁ করছে।

সন্তান হারানো মা–বাবার কাছে গিয়ে নিজেকে যতই আমি একজন প্রতিবেদক, প্রতিবেদনের কাজে এসেছি, এটা প্রমাণ করতে চাই না কেন, কোন ফাঁকে নিজের দুই মেয়ের চেহারা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। মেয়ে দুটি বাসায়, ওদের এডিস মশা যে কামড়াচ্ছে না, তাই–বা কে জানে। কোন ফাঁকে নিজেকে সদ্য হারিয়ে যাওয়া সন্তানের মায়ের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি, তা নিজেও বুঝতে পারি না। তাই আমিও আলগোছে ক্রিকেট ব্যাটটা একটু ছুঁয়ে দেখি। ছোট ছোট জুতা দেখে মনে হয়, থপথপ করে এখনই হয়তো কেউ এসে তার মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরবে।

কাজ শেষ করে অফিসে ফিরতে ফিরতে মনে মনে শিরোনাম সাজাই, ইন্ট্রো সাজাই। মনে হয়, আহা, ওই তথ্যটা তো নেওয়া হলো না। আবার ওই বাবা বা মাকে ফোন দিতে হয়। আচ্ছা মেয়ের কত তারিখে জ্বর এসেছিল, ও তো মারা গেল...।

প্রতিবেদন লিখে জমা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে শরীর অবশ হয়ে যায়। তখন বাবা ও মায়েদের কষ্টটা বেশি করে অনুভব করতে থাকি। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা কথা বলেছেন, প্রতিবেদন করতে সহায়তা করেছেন, তা ভেবে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আর বাসায় ফিরেই কেউ যাতে বুঝতে না পারে—এমন করে মেয়ে দুটিকে দেখি। মনের অজান্তেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি—মেয়ে দুটি ভালো আছে।

ডেঙ্গুতে সন্তান হারানো মা–বাবা অথবা বাবা বা মা কেউ একজন ডেঙ্গুতে চলে গেছেন—এই পরিবারগুলো নিয়ে একেকটি প্রতিবেদন করার পর বুঝতে পারছিলাম মনের ওপর দিয়ে খুব চাপ যাচ্ছে। বাসায় ফিরে অযথাই রাগারাগি করি, রাতে ঘুম থেকে জেগে যাই। তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এমন প্রতিবেদন আর করব না। আমার দুই মেয়ে এবং মেয়ের বাবাও বললেন, কিছুদিন যেন এমন প্রতিবেদন আর না করি।

ফেসবুকে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া খবরগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। এমনও অনেক দিন গেছে, সন্তান হারানো বাবা বা মা নিজেই ফোন করে বলেছেন, আপা, ডেঙ্গুতে এক চিকিৎসকের বাচ্চা মারা গেছে। একটু খবর নিয়ে দেখবেন, ওর তো নিশ্চয়ই চিকিৎসায় কোনো অবহেলা হয়নি, তাহলে মারা গেল কেন? আবার সেই একই অমানবিক প্রক্রিয়ায় আর একটি প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে। এই প্রতিবেদনগুলো পাঠক পড়েছেন। অনলাইনে ভিউ বেশি হয়েছে—এমন প্রতিবেদনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক ভাই কোনো কোনো প্রতিবেদনের জন্য পুরস্কারও দিয়েছেন। তবে অন্য প্রতিবেদন করে পুরস্কার পেলে যে আনন্দ পাই, তা এই প্রতিবেদনগুলোর বেলায় পাইনি। শুধু মনে হয়েছে, আহা, বাচ্চাগুলো যদি কোনোভাবে ফিরে আসত।

করোনার সময়ও এমন অবস্থা গেছে। শুধু ডেঙ্গু বা করোনা কেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও একই অবস্থা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের আসলে প্রশ্ন করার কিছু নেই। তাঁরা যতটুকু বলতে চান, ততটুকু শুনেই লিখতে হয়। একদম স্টোরি হচ্ছে না—এমন মনে হলে কায়দা করে কিছু প্রশ্ন করতেই হয়। প্রতিবেদনের জন্য বাবা, মা বা পরিবারের সদস্যরা কান্না করছেন—এমন ছবিও তুলতে হয়।

ডেঙ্গুতে সন্তান হারানো এক বাবা ভিডিও স্টোরি করার জন্য বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে যে সময় দিয়েছেন, তার ঘণ্টা দুই আগে জানালেন, তিনি বা তাঁর পরিবার আসলে কথা বলতে চাইছেন না। ফোনটা রেখে মেজাজটা একটু খারাপই হলো। তারপর ভাবলাম, নিজেরা কখনো যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ি, তখন কি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলব? নিজের উত্তরটা ছিল—অবশ্যই না। তারপর ভাবলাম, এই জীবনে একটি স্টোরি না করলে এমন কোনো ক্ষতি তো হবে না। এক মা ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া মেয়ের ছবিটা কিছুতেই ছাপাতে চাইলেন না, তখনো প্রথমে একটু মেজাজটা খারাপ হয়েছিল। তারপর নিজেকে ওই মায়ের জায়গায় বসিয়ে দেখলাম, আমি নিজে হলেও হয়তো এমনই করতাম।

ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া কোনো শিশুকে নিয়ে প্রতিবেদন করার পর অফিসের সহকর্মীদের অনেকে বলেছেন, আপা, নিউজের শিরোনাম দেখে আর আপনি লিখেছেন দেখে নিউজটা পড়ার সাহস পাচ্ছি না। অনেকে জানতে চেয়েছেন, আমি ঠিক আছি কি না।
‘ঢাকায় পড়তে আসা মেডিকেলছাত্রীর মৃত্যু, মায়ের চোখের জল “শুকাচ্ছে না”’, ‘ডেঙ্গুতে শত শিশুর মৃত্যু—এই শোক তাঁরা কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন’, ‘বাবা, আমার কিছু হবে না তো?’ ‘মাকে কেন নতুন সাদা কাপড়ে মোড়ানো হলো, জানতে চায় ছোট্ট আইয়ান’, ‘শুধু একবার বাবা বলে চিৎকার করে মেয়েটা লাইফ সাপোর্টে চলে গেল’, ‘ডেঙ্গুতে “অজানা ভ্রমণে” ছোট্ট আফিয়া, সে আর ফিরবে না’, ‘এক মশা আমার পরিবারকে তছনছ আর বাচ্চাগুলোকে এতিম করে দিল’, ‘মেনে নিতে পারছি না, মনে হয় বাচ্চাটা আমার পাশেই আছে’, ‘মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করতে গিয়ে বিতণ্ডায় বাবা গ্রেপ্তার, দিশাহারা পরিবার’, ‘কোনো কিছুর বিনিময়েই স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না’, ‘জ্বরের পরদিন ডেঙ্গু শনাক্ত, দুদিন পরই মৃত্যু বিসিএস কর্মকর্তা নাজিয়ার’, ‘মামা, আম্মুকে কবরে দিয়ে আসছ, আমি আর দেখতে পারব না?’ , ‘মেয়েটা তো সময়ই দিল না, হুট করেই চলে গেল’...এমন শিরোনামের প্রতিবেদনগুলো করতে আসলেই মনের ওপর দিয়ে অনেক চাপ গেছে। শুধু টনক নড়েনি সরকারের। তাই ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাটা কেবল বড়ই হচ্ছে।

মানসুরা হোসাইন
বিশেষ প্রতিবেদক
প্রথম আলো