দেশে সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার ১৭০টি। কিন্তু আছে ৩৩টি। এর মধ্যে পেট-সিটির ব্যবস্থা আছে সাতটিতে।
ঝরনা বেগম (ছদ্মনাম) লসিকা গ্রন্থির ক্যানসারে ভুগছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে কানের যন্ত্রণা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁর বাঁ কানের মধ্যে একটিতে টিউমার ধরা পড়ে। রংপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর তিনি চলে আসেন ঢাকায়।
তবে কানের যন্ত্রণা শেষ হয়নি। একপর্যায়ে ঝরনা বেগমের মুখ বেঁকে যায়। ঢাকার দুটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় এর কোনো উন্নতি হয়নি। পরে আরেকটি হাসপাতালে পরীক্ষায় ঝরনা বেগমের লসিকা গ্রন্থির ক্যানসার শনাক্ত হয়। তিনি গত ১৬ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ক্যানসার বিভাগে।
তাঁকে এখানকার চিকিৎসক ‘পেট–সিটি স্ক্যান’(পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি স্ক্যান অ্যান্ড কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি স্ক্যান) করার পরামর্শ দেন। কিন্তু গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত পরীক্ষাটি করিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
ঝরনা বেগমের বোন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেছেন, পরীক্ষাটি করানোর জন্য তাঁরা বিএসএমএমইউর এফ–ব্লকের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসে (নিনমাস) যোগাযোগ করেন। নিনমাস থেকে তাঁদের বলা হয়, পেট–সিটি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর তালিকা দীর্ঘ। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের আগে তাঁরা এ পরীক্ষা করাতে পারবেন না।
রোগীর শরীরের কোথায় কোথায় ক্যানসার আছে, তা জানার জন্য এ পরীক্ষা জরুরি। ঝরনা বেগমের মতো দেশের বহু ক্যানসার রোগী এ পরীক্ষা করাতে পারছেন না। দেশে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠানে পেট–সিটি স্ক্যান হয়। রোগীরা এ পরীক্ষা করানোর জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করে আছেন।
বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসকেরা পেট–সিটি করার পরামর্শ দেন। পরীক্ষাটি না করালে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু হয় না। বিএসএমএমইউর হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দীন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি বিলম্বে রোগীর ক্ষতি হবে, এ আশঙ্কায় আমরা অনেক ক্ষেত্রে পেট–সিটির রিপোর্ট ছাড়াই চিকিৎসা শুরু করে দিই।’
দেশে কত মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত এবং কোন ধরনের ক্যানসারে ভুগছে, তার নির্ভরযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো দপ্তরে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ (২০২০ সালের) অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, বছরে ১ লাখ ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। সর্বশেষ পাঁচ বছরে দেশে মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার ৮৬৬ জন।
এমন একটা পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সেবায় পার্থক্য কমিয়ে আনুন’। ক্যানসার শনাক্ত ও চিকিৎসায় ধনী ও দরিদ্রে, গ্রামে ও শহরে, নারী ও পুরুষে যে পার্থক্য এখনো আছে, তা কমিয়ে আনার জন্য এ প্রতিপাদ্য বেছে নেওয়া হয়েছে।
অন্য যেকোনো রোগের মতো চিকিৎসকেরা ক্যানসারের ক্ষেত্রেও আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহী। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেট–সিটির একাধিক সুবিধা। প্রথমত এর মাধ্যমে শরীরে আদৌ কোনো ক্যানসার আছে কি না, তা শনাক্ত করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত শরীরে কোথায় কোথায় ক্যানসার আছে, তা জানা যায়। তৃতীয়ত, কী পরিমাণ এলাকাজুড়ে ক্যানসার আছে, তা–ও জানা সম্ভব।’
বিএসএমএমইউ, স্কয়ার হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমপক্ষে দুবার এ পরীক্ষা করাতে চান চিকিৎসকেরা। চিকিৎসা শুরুর আগে পরীক্ষাটি করাতে চান মূলত ক্যানসার পরিস্থিতি জেনে নেওয়ার জন্য। চিকিৎসা চলার একপর্যায়ে আবার এ পরীক্ষা করাত চান চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য। দ্বিতীয়বারের পেট–সিটিতে যদি দেখা যায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন চিকিৎসকেরা চিকিৎসার ধরন বা ওষুধের ডোজে পরিবর্তন আনেন।
সরকারি পর্যায়ে বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, সাভারে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে এ পরীক্ষা হয়। এই চার কেন্দ্রে একবার পরীক্ষা করতে ২৫ হাজার টাকা লাগে। বেসরকারি পর্যায়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল ও মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ পরীক্ষা হয়। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসার এ সুযোগ শুধু ঢাকায়।
এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বুধবার পেট–সিটি স্ক্যান হয়। একেকটি কেন্দ্রে সপ্তাহে ২০ থেকে ৩০ জনের এ পরীক্ষা হয়। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১৮০ জনের এ পরীক্ষা করানো হচ্ছে। অর্থাৎ বছরে ৯ হাজারের কিছু বেশি মানুষ এ পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন।
চিকিৎসা পদার্থবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট–সিটি পরীক্ষার জন্য দরকার হয় ১৮এফ ফ্লুডিঅক্সিগ্লুকোজ (এফজিডি) নামের একধরনের রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস। সরকারিভাবে এটি তৈরি করে শুধু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসে (নিনমাস)। ইউনাইটেড হাসপাতাল ছাড়া বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানে এফডিজি যায় নিনমাস থেকে। নিনমাস পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি প্রতিষ্ঠান। ইউনাইটেড হাসপাতালও কিছু এফজিডি তৈরি করে এবং নিজেরা ব্যবহার করে। এফজিডি তৈরি হওয়ার দুই ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে ব্যবহার করে ফেলতে হয়। তা না হলে এটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ কারণে বিদেশ থেকে এফজিডি আমদানি করা যায় না বা হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের অর্থ হচ্ছে প্রয়োজনীয় জনবলসহ এসব কেন্দ্রে ক্যানসার শনাক্ত ও পরীক্ষার সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা, সব ধরনের থেরাপি (কেমো ও রেডিও থেরাপি) ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র থাকা দরকার ১৭০টি। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এমন কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে পেট–সিটির সুযোগ আছে কেবল সাতটি প্রতিষ্ঠানে।
পেট–সিটির সুযোগ আরও বাড়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা যন্ত্রটি কিনেছে ১৫ কোটি টাকায়। বিএসএমএমইউর ক্যানসার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারিভাবে প্রথমে অন্তত সাতটি বিভাগীয় শহরে পেট–সিটি পরীক্ষার উদ্যোগ নিলে অনেক বেশি রোগী রোগ শনাক্তের এ আধুনিক সুযোগ পাবে। পাশাপাশি ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ কমবে। ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোও এ উদ্যোগ নিতে পারে।’