সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ এমনিতে চুপচাপ শান্ত মানুষ। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। সেই ধাঁচটা অবসরের পরও যায়নি। একটি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়ার পর বদলে গেল তাঁর কথার ধরন। স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে পৌঁছে গেলেন নিজের কিশোর বয়সে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মানুষ সুভাষ প্রথমবারের মতো হাতঘড়ি ব্যবহার করেছিলেন কলেজে ভর্তি হয়ে, ১৯৬৪ সালে। বড় ভাই রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ঘড়িটি ছিল স্টিলের বেল্টে সাদা ডায়ালের। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসরে গেছেন সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ। প্রথম আলোকে জানালেন, ছাত্রজীবনে সময়ের হিসাব মেলাতেন স্কুলের ঘণ্টা শুনে। ঘড়ির ব্যবহার ছিল বড়দের ব্যাপার।
মফস্সলের কোনো কোনো স্টুডিওতে ছবি তুলতে উৎসাহী করার জন্য লেখা থাকত ‘রূপ থাকলে ধরে দেব, না থাকলে গড়ে দেব’। জসিমউদ্দীনের কবিতার ‘কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা’ পঙ্ক্তি ওই বাক্যটির অনুপ্রেরণা কি না, বলা কঠিন।
সাদামাটা চেহারার ডব্লিউআর মডেলের ক্যাসিও ঘড়ি একসময় ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। এটি একই সঙ্গে তখনকার দিনে সচ্ছলতার প্রতীকও বটে। এখন কারও হাতে আর সচরাচর দেখা যায় না। সময় বুঝতে ছাত্রদেরও আর স্কুলের ঘণ্টার জন্য কান পেতে থাকতে হয় না। হাতঘড়ি ব্যবহারের সঙ্গে বয়স, সংগতির মাপজোকের হিসাবটাও একই রকম নেই। তবু অতীত প্রসঙ্গ এলেই মানুষ কেন স্মৃতিকাতর হয়, তা জানতে প্রথম আলো কথা বলেছে দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের সঙ্গে। তাদের কেউ সংগ্রহ করেন পুরোনো জিনিস। হাওরঘেঁষা বাড়ি বদলে শহরে আসায় বদলে গেছে কারও জীবনাচার। তাঁরা বলছেন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও আকাশ–সংস্কৃতির ফলে গত দুই দশকে এমন অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, যা একসময় ছিল খুবই আপন। প্যানাসোনিক রেডিও থেকে তিন ব্যাটারির টর্চ, কাঁসার বাসনে নাম খোদাইয়ের প্রচলন থেকে স্টুডিওতে ছবি তোলার শখ—এমন অনেক স্মৃতিই ধরে রাখে মানুষের ইতিহাস।
একসময় স্টুডিওতে ছবি তোলা ছিল রীতিমতো পারিবারিক উৎসব। মফস্সলের কোনো কোনো স্টুডিওতে ছবি তুলতে আরও একটু উৎসাহী করার জন্য লেখা থাকত ‘রূপ থাকলে ধরে দেব, না থাকলে গড়ে দেব’। জসীমউদ্দীনের কবিতার ‘কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা’ পঙ্ক্তি ওই বাক্যটির অনুপ্রেরণা কি না, বলা কঠিন। তবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি তোলার সুযোগের আগে পাত্রী দেখার প্রাথমিক ব্যবস্থা ছিল স্টুডিওতে তোলা একটি ছবি। লাইটের দিকে মুখ রেখে, তীব্র আলোর ছটা উপেক্ষা করে বড় বড় চোখে বাক্স ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকানোর নির্দেশ দিতেন আলোকচিত্রী। যাঁরা সেই লালমনিরহাট বা ভোলা থেকে সাভারের স্মৃতিসৌধ দেখতে আসতে পারতেন না তাঁরা শখ মেটাতেন স্টুডিওর দেয়ালে ঝোলানো স্মৃতিসৌধের পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে।
কবি জসীমউদ্দীনের শহর ফরিদপুরের নীলটুলিতে এখনো আছে ‘ফুজি’ নামে ৫০ বছরের পুরোনো একটি স্টুডিও। রংচটা সোফা আর ভাঙা কাচের টেবিল সামনে নিয়ে দিনভর একা দাঁড়িয়ে থাকেন আলোকচিত্রী কমল সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘কত রকম পোজ যে ছিল। আর চুলের কাটিং নিয়ে কত উদ্বেগ ছেলেদের! ছবি তোলার আগে তাঁরাও মুখে একটু পাউডার, আর চুলে পানির ছিটা দিয়ে পরিপাটি হয়ে নিত। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য অনেক রকম দৃশ্য কিনতে হয়েছে। এখন দিনে দু-একজন কাস্টমার আসে পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে। মানুষের দরকারই হয় না স্টুডিওর।’
ফরিদপুরের দয়ারামপুরের ভূমিপুত্র মজিদ মাতবর জানান, তাঁদের সময় তিন ব্যাটারির টর্চ মানে সে পয়সাওয়ালা মানুষ। খেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফাঁকা জায়গায় টর্চ ফেললে নাকি দুই মাইল দূরের জিনিসও দেখা যেত।
দরকার হয় না বলে এভাবে স্মৃতির খাতায় জমা হয়েছে সাদাকালো টেলিভিশন সেট, ভিসিআর প্লেয়ার। বিত্তবান মানুষেরা সেই সাদাকালো টেলিভিশনটি রাখতেন আবার কাঠের বাক্সের ভেতর। আর ভিসিআরের ক্যাসেট দোকান থেকে ভাড়া নেওয়া যেত ১০ টাকা করে। শীতকালে বিয়েবাড়িতে চাদর জড়িয়ে বসে রাত জেগে হিন্দি সিনেমা দেখার আমেজটা খুব মনে আছে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেনের। তবে এ কাজটি যখন তাঁর সন্তানেরা নব্বইয়ের দশকের শেষে করতে গেছেন, প্রতিবারই তিনি লাঠি হাতে তাড়া করেছেন। ফেলে আসা সময়ের কথা বলতে গিয়ে যেন একটু বিমর্ষ মুখে হাসলেন সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি।
কিন্তু সমবয়সী মজিদ মাতবরের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। স্মৃতির তোরঙ্গ খুলতেই বরং তিনি আরও গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। তাঁর ছিল তিন ব্যাটারির টর্চলাইট ও একটি রেডিও। ভরদুপুরে মাঠের কাজের তদারকি করতে করতে তিনি রেডিওতে শুনতেন অনুরোধের গানের আসর। ফরিদপুরের দয়ারামপুরের ভূমিপুত্র মজিদ মাতবর টর্চের প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁদের সময় তিন ব্যাটারির টর্চ মানে সে পয়সাওয়ালা মানুষ। খেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফাঁকা জায়গায় টর্চ ফেললে নাকি দুই মাইল দূরের জিনিসও দেখা যেত।
ব্যবহারকারীর পায়ের মাপে কাঠ কেটে সামনের দুই আঙুলের মধ্যে বল্টু বসিয়ে বানানো খড়ম কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা প্রবাদে ‘খড়মপেটা’ হিসেবে স্থান করে নেওয়ায় ধারণা করা যায়।
ফেলে আসা দিনের কথায় হয়তো বয়স্ক মানুষটি অনেকটা বেশিই বলেছেন। তবে স্মৃতির শক্তি এখানেই। যা কিছু মনে দাগ কাটে, তা পুরোনো হতে হতে আরও বেশি মূল্যবান হয়। মজিদ মাতবর যে সময়ের কথা বলছেন তখন জনপ্রিয় ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ব্যাটারির একটি বিজ্ঞাপন। মিতা নূর তোলপাড় করেছিলেন ‘আলো আলো বেশি আলো’ জিঙ্গেলের সঙ্গে নেচে। অলিম্পিক ব্যাটারির প্রচারণার মতো হারিয়েছে অনেক বিজ্ঞাপনও। নারীদের জন্য কিউট শ্যাম্পু বা মালা শাড়ি, শিশুদের আট আনার চকলেট বা কমলার কোয়ার ছবি বসানো মিমির বিজ্ঞাপন গত দুই দশকে আর প্রচারিত হয়নি।
এভাবে কখন যেন হারিয়ে গেছে শিশুদের কিছু পরিচিত শখও। দুই দশক আগে তখনো জাঁকিয়ে বসেনি প্রযুক্তিপণ্য। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা ছিল নানা দেশের মুদ্রা আর স্ট্যাম্পের মালিক। সংগ্রহে একই রকম দুটো থাকলে তা বিনিময় করে আরেকজনের কাছ থেকে আনা হতো ভিন্ন একটি। কার কাছে কত দেশের মুদ্রা বা স্ট্যাম্প আছে সেটা ছিল গর্বের বিষয়। তখন মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বিভিন্ন আত্মীয়ের চিঠির সঙ্গে আসত এসব স্ট্যাম্প। এখন আর হাতে লেখা চিঠিও আসে না, ব্যবহার করা হয় না ১ টাকার পোস্টকার্ড। যে কার্ডের দুটো পাশই পড়া যেত বলে সেখানে লেখা থাকত শুধু জরুরি কথা।
জরুরি কথার সঙ্গে আলাপসালাপ তখনো চলত অ্যানালগ ফোনওয়ালা বাড়িতে। নম্বরের ডায়াল ঘুরিয়ে ফোনকল করার সুযোগ নিত কনিষ্ঠরাও। তাই ছোট্ট একটা চাইনিজ তালা লাগানো হতো সেসব ফোনে। আর অধিকাংশ সময় তা রাখা হতো বড়দের নজরদারির মধ্যে। পরে অবশ্য গান শুনতে শুনতে ওয়াকম্যান ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিল উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা। তারা কানে হেডফোন দিয়ে সোলস বা চাইমের গান না শুনলে অঙ্ক করতে পারত না বলে দাবি করত। এই ধারাবাহিকতায় কম্পিউটারের সঙ্গে প্রথম প্রথম ব্যবহার হতো ফ্লপি ডিস্ক।
কালির কাজল বানাতেও ব্যবহার হতো কাঁসার কাজলদানি। কাজল দিয়ে শিশুর কপালে টিপ দিলে নজর লাগবে না বলে বিশ্বাস ছিল। নজর লাগার ভয়ের মতো মানবিক কিছু সংস্কার হারিয়েছে মানুষ।
কম্পিউটারের স্ক্রিনে চাইলেই জমিয়ে রাখা যেকোনো ছবি, যখন-তখন দেখা যায়। সেই সময় থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল পোস্টার আর ভিউকার্ড। প্রমাণ আকারের পোস্টার গ্রামের বাড়ির টিনের ঘরের ভাঙা অংশ ঢাকতে যেমন কাজে লাগত, তেমনি চোখের সামনে থাকলে মনে আনন্দও হতো অনেকের। প্রিয় নায়ক-নায়িকার ছবির সঙ্গে অনেক বাড়িতে জায়গা পেয়েছে মানুষের বিশ্বাসের প্রতিলিপির ছবিও। পাখাওয়ালা ঘোড়ার মাথায় নারীর মুখের বোরাকের ছবি ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
এই ঘোড়ার গতি মানুষ নির্ধারণ করত নিজের কল্পনায়। তবে ৫০ বা ৭৫ সিসির মোটরসাইকেল হরদম চলত সড়কে। লালরঙা সেই ‘হোন্ডায়’ দিব্যি ধরে যেত পরিবারের চার সদস্য। রাজশাহীর নাচোলের স্কুলশিক্ষক আজিজুর রহমান এখনো এমন একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। সম্প্রতি তিনি আরেক মোটরসাইকেলের সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রথম আলোকে বললেন, বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির মোটরসাইকেলটিকে মাত্রই দেখেছিলেন মসজিদের কাছে। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে সেটি এসে মুখোমুখি কেমন করে হলো তিনি বুঝতে পারছেন না।
খুলনার লোকগবেষক বাবলা বিশ্বাসও এমন একটি সাইকেল ব্যবহার করতেন। সম্প্রতি পুরোনো অনেক কিছু তিনি বাতিল করেছেন। বাহনটি বিক্রি করেছেন মাত্র ১৭ হাজার টাকায়। তবে অনেক যত্নে নিজের সংগ্রহে থাকা পুরোনো প্রত্নতত্ত্ব রেখেছেন। মাটির তৈরি ছোট ছোট এসব পাত্র সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া। প্রথম আলোকে বললেন, ‘এগুলোর নির্দিষ্ট সময়কাল আমি নির্ধারণ করতে পারব না। তবে প্রত্নতত্ত্বগুলো নির্দেশ করে, আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে সংগঠিত, পরিকল্পিত বসতিসহ অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল একসময়।’
সুন্দরবন থেকে পাওয়া বাবলা বিশ্বাসের এই মাটির পাত্র আমাদের কাছে অচেনা হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। যেমন অমূল্য পূর্বপুরুষের খড়ম জোড়া। পায়ের মাপে কাঠ কেটে বানানো খড়মের শব্দ এখনকার প্রজন্ম চেনে না। কিন্তু একসময় ওই শব্দটি গুরুজনের আগমনবার্তার সতর্কতা হিসেবেও কাজ করেছে। বাড়ির ছোটরা ঠাকুরদা অথবা বাবা আসছেন—এই সংকেত পেয়ে বই খুলে বসত।
ব্যবহারকারীর পায়ের মাপে কাঠ কেটে সামনের দুই আঙুলের মাঝে বল্টু বসিয়ে বানানো খড়ম কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা প্রবাদে ‘খড়মপেটা’ হিসেবে স্থান করে নেওয়ায় ধারণা করা যায়। এ অঞ্চলের লোকজ সাহিত্যে খড়মের কথা উঠে এসেছে হাস্যরসের ভেতর দিয়ে। ছেলেপিলেরা কোনো এক হরম বিবিকে চটাতে সুর করে করে হরম বিবির খড়ম পায়ে আছাড় খেয়ে বারবার পেছন ফিরে তাকানো নিয়ে একটি ছড়া বলত। হরম বিবি পেছনে ফিরে ফিরে চাইতেন কি না, জানা নেই। কিন্তু জীবনের একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে মানুষ পেছনে তাকায়। স্মৃতির মহাফেজখানায় চোখ দিয়ে মেপে নেয় নিজের জীবনের দৈর্ঘ্য–প্রস্থ।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বাড়ি সবিতা বিশ্বাসের। ৬০ বছর অতিক্রম করেছেন তিনি। তাঁর কাছে আছে ঠাকুরমার সময়ে ব্যবহার করা কাঁসার কিছু থালাবাসন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসনকোসনগুলোর অনেক ওজন। আমাদের খাবারের ঘরে কাচের টেবিল ব্যবহার শুরুর আগেও আমি চেষ্টা করতাম কয়েকটি ব্যবহারের। এখন আর সম্ভব হয় না। মাঝেমধ্যে তেঁতুলজল দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আবার তুলে রাখি। যখন থাকব না, তখন হয়তো এগুলো কেজি দরে বিক্রি হয়ে যাবে।’
কাঁসার বাসন আসলে বিক্রিই হয়ে যায়। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে উপহারের টেবিলে শোভা পেত গলায় কাগজের মালা ঝোলানো কাঁসার কলস। ঘরে ব্যবহারের অনেক জিনিসেই খোদাই করে লেখা হতো নাম। কালির কাজল বানাতেও ব্যবহার করা হতো কাঁসার কাজলদানি। কাজল দিয়ে শিশুর কপালে টিপ দিলে নজর লাগবে না বলে বিশ্বাস ছিল। নজর লাগার ভয়ের মতো মানবিক কিছু সংস্কার হারিয়েছে মানুষ।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার লিংকন দাস ধামাইল গানের টান দিলে শ্রোতার হৃদয় কাতর হয়ে ওঠে। এখন সিলেট শহরে এক বইয়ের দোকানের কর্মকর্তা লিংকন। কম্পিউটারে একটি বইয়ের নাম খুঁজতে খুঁজতে লিংকন প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমাদের বাড়ি হাওরে। হাওরের মানুষের কণ্ঠে সুরটা এত ভালো খেলে কেন জানেন? তাঁরা একা মাছ ধরতে ধরতে খোলা গলায় নিজেকে শোনাতেই গায়। আমাদের বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় পদ্মপুরাণ সুর করে পড়া হতো। বাবা-মাকে নিয়ে এসেছি সিলেটে। মায়ের কাছ থেকে এখন আর পদ্মপুরাণের সুর শোনা যায় না।’
এই সুর ছিল ফসলের মাঠের ঢেঁকিকল আর গৃহস্থ বাড়ির ঢেঁকিতেও। টানা ছন্দের সেসব শব্দও হারিয়েছে, কোনটি হারাচ্ছে এখন। তবে হবিগঞ্জের রাজনগরের বাবলা বৈদ্য তাদের পরিবারের অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করা কয়লার ইস্ত্রিটি এখনো ধরে রেখেছেন। শ্রীমঙ্গলের বসতি গুটিয়ে হবিগঞ্জে আসার সময় সঙ্গে এনেছেন সেটি। এখনকার লন্ড্রিতে এর ব্যবহার সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু বাবলা বৈদ্য জানান, বৈদ্যুতিক ইস্তিরির চেয়ে অনেক বেশি ভালো কাজ করে এটি। তাই তাঁর দোকানে মানুষ আসেও বেশি।
ফরিদপুরের ঝিলটুলির মসজিদ বাড়ি সড়কের একটি বাড়িতেও একসময় রোজ অনেক মানুষ আসত। সে বাড়ির দুই বর্ষীয়ান মানুষের এখন নিজেদের চলাফেরা করতেই কষ্ট হয়। তাঁরা একা থাকেন। মানুষের আনাগোনা কমেছে অনেক দিন হলো। এ বাড়ির অধিকাংশ জিনিসপত্র অনেক দিন আগের। পুরোনো কাঠের পুরোনো শোকেসে রাখা আছে তাঁদের সন্তানদের খেলার ভিডিও গেমসের যন্ত্র, প্লাস্টিকের ওয়াকিটকি বা দোয়াত–কলম। এসব সংরক্ষণ কষ্টের হলেও কোনোটিই ফেলতে চান না সে বাড়ির নারী।
এভাবে জমিয়ে রাখছেন কেন, জানতে চাইলে রাবেয়া ইমাম বললেন, ‘এসব শুধু বস্তু নয়। এই তো সেদিনও আমার সন্তানেরা ব্যবহার করেছে। এগুলোর দিকে তাকালে আমি তাদের সেই বয়সটা দেখি। মনে হয় সন্তানেরা কাছেই আছে। আমার কাছে বাতিল হওয়া জিনিসগুলোই এখন অমূল্য।’