কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হলো টানেল। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার পর্যন্ত শিল্পায়ন, পর্যটন ও নগরায়ণের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পের গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক সুফল নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মাসুদ মিলাদ ও জে্যষ্ঠ প্রতিবেদক সুজন ঘোষ।
কয়েকটি বড় প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় বলে আপনি সমালোচনা করেছেন। সে জায়গা থেকে টানেল নির্মাণ প্রকল্পকে কীভাবে দেখছেন?
মইনুল ইসলাম: আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশে অনেক মেগা (বড়) প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর প্রয়োজন ছিল না। পদ্মা সেতু দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ চালু হওয়ায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করে রেললাইন প্রকল্পের দরকার ছিল না। একইভাবে ১২ বিলিয়নের বেশি ডলার খরচ করে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পেরও দরকার ছিল না। বরং এর চেয়ে নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্ধেক খরচে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর কার্যকর না হওয়ায় রেললাইনের ব্যবহার বাড়বে না।
এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের চেয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বরং অনেক বেশি দূরদর্শী প্রকল্প। দুই দশক আগে ২০০৩ সালে চট্টগ্রামে এক সেমিনারে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সুফল নিয়ে বলেছিলাম।
রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথম টানেল নির্মাণের দাবি তোলেন। বিএনপি সরকার টানেল নিয়ে গুরুত্ব দেয়নি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাব ধরে এগোতে থাকে। বর্তমান সরকার এই প্রকল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করে তা বাস্তবায়ন করেছে।
টানেল চালু হওয়ায় এখন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার, বিশেষ করে সাগর উপকূলীয় এলাকা নগরায়ণ, পর্যটন ও শিল্পায়নের নতুন কেন্দ্রস্থল হবে। এলাকাটি দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর হওয়ার সম্ভাবনা ধারণ করবে বলে আমি মনে করি।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজারে এখনো খুব বেশি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। শুরুতে টানেলের ব্যবহার বাড়বে?
মইনুল ইসলাম: পদ্মা সেতুর মতো শুরুতে টানেলের টোল দিয়ে কিস্তি পরিশোধের আশা করা ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, আগামী ১০ বছর লাগবে টানেলের টোল দিয়ে কিস্তি পরিশোধের আয় আসতে। তবে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সাগর উপকূল ধরে বিশাল এলাকা শিল্পায়নের নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
এখনই কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার কারখানার পণ্য টানেল দিয়ে কম সময়ে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। আনোয়ারা ও মহেশখালীতে নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। শিল্পকারখানা হচ্ছে। সামনে এসব শিল্পকারখানার পণ্য পরিবহন হবে টানেল দিয়ে। এতে টানেলের ব্যবহারও বাড়তে থাকবে। এই অঞ্চলের শিল্পায়নে কর্ণফুলী টানেল বড় ধরনের অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
শিল্পায়নের দুয়ার খুলে যাওয়ার মূল কারণ কী শুধু টানেল?
মইনুল ইসলাম: শিল্পায়নের জন্য প্রথম দরকার সহজ যোগাযোগব্যবস্থা। টানেলের কারণে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। তবে শুধু সহজ যোগাযোগব্যবস্থা দিয়ে শিল্পায়ন হয় না। শিল্পায়নের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ, জমির সহজলভ্যতা, বন্দর—এসবও দরকার। আমদানি করা গ্যাস নেওয়া হচ্ছে এই অঞ্চল দিয়ে।
বিদ্যুতের বড় দুটি প্রকল্পও রয়েছে বাঁশখালী ও মহেশখালীতে। অর্থাৎ গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য আলাদা করে বড় কোনো প্রকল্প নিতে হবে না। আবার দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সাগর উপকূলের কাছাকাছি জমির সহজলভ্যতাও আছে। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অর্থাৎ শিল্পায়নের সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এ অঞ্চলে। এখন শুধু পরিকল্পনা দরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের মতো শিল্পকারখানার এলাকা গড়ে তোলা।
বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যক্রম থমকে আছে। এ ক্ষেত্রে শুধু দেশি চাহিদা দিয়ে টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো বড় বড় প্রকল্পগুলোর সুফল পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব?
মইনুল ইসলাম: বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার—এই চার দেশের অর্থনৈতিক করিডর বা বিসিআইএম যদি কার্যকর থাকত, তাহলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সুফল পেত। কারণ, ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত যোগাযোগ অবকাঠামোর কেন্দ্রস্থলে ছিল বাংলাদেশ।
বিসিআইএম করিডরকে কেন্দ্র করে চীন সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। ভারতের আপত্তিতে সোনাদিয়া প্রকল্প আর হয়নি। তখন থেকেই কার্যত অর্থনৈতিক করিডরের কার্যক্রমও থমকে আছে।
বিসিআইএম করিডরের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যকর হলে অনেক বেশি সুফল পাওয়া যেত। এই অঞ্চল অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগত না। অর্থনৈতিক হাব হওয়ার সব যোগ্যতা রয়েছে এখানে। ভারত ও চীন এই দুই দেশের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে।