করতোয়ায় নৌকাডুবি

মাকে পেয়েছেন দীপক, কিন্তু মৃত

মাকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক দীপক চন্দ্র বর্মন। মঙ্গলবার সকালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার শিকারপুর প্রধানপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত রোববার নাতি তন্ময়কে সঙ্গে নিয়ে নদী পার হচ্ছিলেন আদুরী রানী। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। তন্ময় পাড়ে উঠে এলেও আদুরী রানী হারিয়ে যান। মায়ের খোঁজে গতকাল সোমবার ভোরে করতোয়াপাড়ে ছুটে আসেন আদুরী রানীর ছেলে দীপক চন্দ্র বর্মণ। তখন দীপক জানিয়েছিলেন, নৌকাডুবির পর ছেলে ফিরে এলেও মাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। একবারের জন্য হলেও মায়ের মুখটা দেখতে চান তিনি।

দীপকের প্রার্থনা পূরণ হয়েছে। উদ্ধার হয়েছেন তাঁর মা, তবে দেহে প্রাণ নেই। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার শিকারপুর প্রধানপাড়া গ্রামে দীপকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনের ভিড়। সেখানে চলছে পূজা অর্চনা চলছে। পূজা শেষে দীপক তাঁর বাবা হেম কুমার, ছোট ভাই ঈশ্বর বর্মণকে নিয়ে বারান্দায় বসে কলাপাতায় খাবার খাচ্ছেন। পরে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকদের কথা হয়। দীপক হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘দাদা, আমার মাকে পেলাম কিন্তু মায়ের মুখের হাসি নাই।’

পরে নিজেকে সামলে নিয়ে দীপক বলতে লাগলেন, ‘মাকে কত জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। শেষে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, মা যেন ফিরে আসেন, তাঁর মুখটা যেন একবার দেখতে পাই। গতকাল দুপুরে মায়ের লাশ উদ্ধার হয়। ফেসবুকে মায়ের ছবি দেখে তাঁকে চিনতে পারি। নৌকাডুবির ঘটনায় স্থাপন করা তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে জানায়, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার স্লুইসগেট এলাকা থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। পরে সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, উদ্ধার হওয়া নারীই আমার মা। মাকে যখন খুঁজে পেলাম, তখন মায়ের প্রাণ নেই। আমার মা আর আমাকে ডাকবেন না, আমার কাছে আসবেনও না। আর কোনো দিন মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাবেনও না।’

দীপকের চাচাতো ভাই তীলাক্ষ্য বর্মণ বলেন, ‘মহালয়া অনুষ্ঠানে যাবারতানে আমি, কাকিমা, তন্ময়সহ নয়জন নৌকায় চড়িয়া নদী পার হচ্ছিনু। মাঝপথে নৌকা উল্টি গেইল, হামরা সবাই পানিত ডুবে গেনু। হামরা আটজন নদীর পাড়ে উঠি আসিলেও কাকিমা খোঁজ পাওনি। কাইল বিকালত কাকিমার লাশ পাওয়া গেইছে।’ আদুরী রানীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর জা শোভা রানী। তিনি বলেন, ‘মুই আর দিদি একঠে ছিনু। পানিত পড়ে যাওয়ার সময় দিদি মোর হাতখান ধরে ছিল। কিন্তু পানির নিচত যায়ে দেখু দিদি নাই।’

দীপকের ছেলে তন্ময়কে খুব ভালোবাসতেন আদুরী রানী। কোথাও বের হলে তাকেই নিয়ে যেতেন। মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তন্ময়কে নিয়ে বের হন। ৯ বছর বয়সী তন্ময় বলে, ‘পানি থেকে উঠে আসার পর, আমি দিদিকে অনেক খুঁজছি। কিন্তু পাইনি।’

ফেরার সময় দীপক বলেন, ‘গতকাল রাতে মায়ের লাশ দাহ করা হয়েছে। কষ্ট লাগছে, আমার মা আর আমাকে ডাকবেন না, আমার কাছে আসবেনও না। তন্ময়কে আর কোনো দিন মহালয়ার অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবেনও না।’

রোববার দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় আজ বিকেল ৪টা পর্যন্ত মোট ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন।