পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার মোট পাকা সড়কের প্রায় অর্ধেকই বেহাল। দশ‌মিনা উপ‌জেলার বহরমপুর ইউ‌নিয়‌নের মোল্লাবাজার এলাকায় এভাবে সড়‌কের ওপ‌রের অংশ উ‌ঠে ক্ষত‌বিক্ষত হ‌য়েছে। মঙ্গলবার সকা‌লে তোলা
পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার মোট পাকা সড়কের প্রায় অর্ধেকই বেহাল। দশ‌মিনা উপ‌জেলার বহরমপুর ইউ‌নিয়‌নের মোল্লাবাজার এলাকায় এভাবে সড়‌কের ওপ‌রের অংশ উ‌ঠে ক্ষত‌বিক্ষত হ‌য়েছে। মঙ্গলবার সকা‌লে তোলা

এলজিইডির গ্রামীণ সড়ক

৫০% সড়কেরই মেরামত প্রয়োজন 

সংস্কারের অভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার রতনদী তালতলী ইউনিয়ন থেকে চরবিশ্বাস পর্যন্ত সড়কটি প্রায় ২০ কিলোমিটার। পুরো সড়কটিই বেহাল। কোথাও ঢালাই উঠে খোয়া বের হয়ে আছে, কোথাও ছোট-বড় গর্ত। গত ১০ বছরে সংস্কার না হওয়ায় এই পথে চলাচলকারীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। 

সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীন। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক এলজিইডির। এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, এলজিইডির ৫০ শতাংশ সড়ক সব সময় ভালো থাকে। বাকি ৫০ শতাংশ সড়কের কমবেশি মেরামত প্রয়োজন। এর মধ্যে সংস্কারের অভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ব্যবহারের অনুপযোগী এসব সড়কের প্রায় সবটাই গ্রামের কাঁচা সড়ক।

এলজিইডির বেহাল সড়কের বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হচ্ছে। গত রোববার পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা ও দশমিনা) আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা জাতীয় সংসদে নিজ এলাকার সড়কের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘রাস্তাঘাটের খারাপ অবস্থার কারণে ভোট চাইতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল।’ একই দিন সাতক্ষীরা-২ আসনের (সদর) সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী ওই রাস্তায় চলাচল করলে পথেই “ডেলিভারি” (সন্তান প্রসব) হয়ে যাবে।’ 

এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, এলজিইডির ৫০ শতাংশ সড়ক সব সময় ভালো থাকে। বাকি ৫০ শতাংশ সড়কের কমবেশি মেরামত প্রয়োজন। এর মধ্যে সংস্কারের অভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এলজিইডির প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বেহাল সড়কের বেশ কিছু কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিম্নমানের নির্মাণকাজ, অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচল, অতিবৃষ্টি, সড়কের পাশের পুকুরের পাড় বাঁধানো না থাকা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সড়কে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। আরেকটি বড় কারণ, প্রতিবছর যে পরিমাণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের চাহিদা থাকে, বরাদ্দ থাকছে তার তুলনায় অনেক কম।

সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডির যে বরাদ্দ দরকার, তা পায় না, এটি সত্যি। কিন্তু বরাদ্দ থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ হয় না। কারণ, যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে মান ধরে রাখা কঠিন।
অধ্যাপক আকতার মাহমুদ, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এলজিইডির রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুস সবুর প্রথম আলোকে বলেন, চলতি অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজন ছিল ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বরাদ্দ হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যে বরাদ্দ থাকে, তার বড় অংশ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দেওয়া হয়। সড়কের স্থায়িত্ব বাড়াতে নতুন করা সড়কের ছোট-বড় গর্ত প্রতিবছর মেরামত করা জরুরি। এখন সেদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। 

সংস্কার হয় না দীর্ঘদিন

পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার মোট পাকা সড়কের প্রায় অর্ধেকই বেহাল। এলজিইডির পটুয়াখালী কার্যালয় সূত্র জানায়, এ দুই উপজেলায় পাকা সড়ক রয়েছে ৬০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৩৫ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এই দুই উপজেলায় ২ হাজার ২০৪ কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা সড়ক রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশির সংস্কার প্রয়োজন। 

মঙ্গলবার দেখা যায়, গলাচিপার কালিকাপুর থেকে পানপট্টি, গলাচিপা সদর ইউনিয়ন থেকে কলাগাছিয়া ইউনিয়ন সড়ক, দশমিনা উপজেলার বহরমপুর ইউনিয়নের আমতলা থেকে মোল্লার হাট হয়ে বেতাগি সানকিপুর ইউনিয়ন এবং আবজবেগী বাজার সড়কগুলোতে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

গলাচিপা উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কগুলো দিয়ে ৮ টন ওজনের যানবাহন চলাচলের কথা। কিন্তু তরমুজের মৌসুমে ২০ থেকে ৩০ টন তরমুজ নিয়েও ট্রাক-লরি চলাচল করে। এতে সড়কগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এ সড়কগুলো ১০ বছরেও সংস্কার হয়নি। এ কারণে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

অপর দিকে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বেকীপুল বাজার থেকে মাঝিনা পর্যন্ত সোয়া কিলোমিটার সড়কে প্রায় তিন বছর ধরে খোয়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে। পিচঢালাই না করায় পুরো সড়ক এখন ধুলায় আচ্ছন্ন এবং রয়েছে ছোট-বড় গর্ত। ইন্দ্রপুর, বেকীপুল ও মাঝিনা গ্রামের লোকজনের যাতায়াত এ সড়ক দিয়ে। স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী মিরাজ ইসলাম বলেন, ‘তিন বছর হই যাছে রাস্তাটাত খোয়া ফেলে রাখিছে। যাওয়া আইসাতে মানুষের কষ্ট। অটোর ভাড়াও বেশি দিতে হয়।’ 

রাস্তাঘাটের খারাপ অবস্থার কারণে ভোট চাইতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল।
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা ও দশমিনা) আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা

কাঁচা সড়ক বেশি ভাঙাচোরা

সরকারের জাতীয় সড়কব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কের দায়িত্ব এলজিইডির। সংস্থাটির আওতাধীন গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও সংস্থাটির। এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, তাদের আওতায় মোট ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৫৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ পাকা ও ৫৮ শতাংশ কাঁচা সড়ক।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের পয়লা-রুকনাই দক্ষিণপাড়া সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন অন্তত ছয়টি গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ। কাঁচা এই সড়কে ছোট-বড় অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসী প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁচা সড়কটি পাকা করার দাবি জানাচ্ছেন অনেক আগে থেকে। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদা জমলে হেঁটেও চলাচল করা যায় না। 

এলজিইডির অধীন থাকা গ্রামীণ সড়ককে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক, গ্রাম সড়ক (ক শ্রেণি) ও গ্রাম সড়ক (খ শ্রেণি)। এলজিইডি প্রতিবছর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করে। এলজিইডি সূত্র বলছে, যে সড়কে যানবাহন চলাচল বেশি, উপজেলা ও ইউনিয়নের সংযোগকারী সড়ক, হাটবাজারের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে—এমন সব সড়কই সংস্থাটি গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করে। কাঁচা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডি অর্থ বরাদ্দ কম দেওয়ায় তা ভাঙাচোরা অবস্থায় থাকে। 

সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডির যে বরাদ্দ দরকার, তা পায় না, এটি সত্যি। কিন্তু বরাদ্দ থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ হয় না। কারণ, যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে মান ধরে রাখা কঠিন। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ

চাহিদার ১৫ শতাংশ বরাদ্দ

প্রতিবছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে সরকার রাজস্ব খাতের মাধ্যমে এলজিইডিকে বরাদ্দ দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই খাতে অর্থের চাহিদাও বেড়েছে। এলজিইডির রক্ষণাবেক্ষণ শাখার প্রকৌশলীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়া যায়। এতে প্রতিবছর প্রয়োজনীয়সংখ্যক সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হয় না।

এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, গত তিন অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে রাজস্ব খাত থেকে সংস্থাটি ব্যয় করেছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব খাত থেকে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে এই সর্বশেষ তিন অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডির চাহিদা ছিল ৫৯ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার। অর্থাৎ চাহিদার ১৫ শতাংশের কম বরাদ্দ পেয়েছে সংস্থাটি। 

এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে চার ধরনের কাজ করে। এগুলো হলো যেসব সড়কে গর্ত তৈরি হয়েছে, সেগুলো ভরাট (রি-সিল), মোটামুটি থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত (ওভার-লে), সড়কের আয়ুষ্কাল কমে গেলে তা পুনর্বাসন এবং সড়ক প্রশস্ত করা। তবে সংস্থাটির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণকাজের বড় অংশ অর্থই ব্যয় হয় মেরামতের পেছনে।

বরাদ্দ থাকলেও এলজিইডির কাজের মান ঠিক থাকে না বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডির যে বরাদ্দ দরকার, তা পায় না, এটি সত্যি। কিন্তু বরাদ্দ থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ হয় না। কারণ, যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে মান ধরে রাখা কঠিন। 

দুই কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের সড়ক উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কারের এখতিয়ার রয়েছে। বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নিজেদের আওতাধীন সড়ক সংস্কার করলে এলজিইডির ওপর চাপ কমত। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে পর্যায়ক্রমে সব সড়কে রক্ষণাবেক্ষণকাজ হলে কোনো সড়কই বেশি খারাপ থাকবে না। 

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শংকর দাস (পটুয়াখালী), খলিল রহমান (সুনামগঞ্জ) ও রাজিউল ইসলাম (দিনাজপুর)]