সরকারি চারটি মেডিকেল কলেজ ও একটি ডেন্টাল কলেজে চিকিৎসা শিক্ষার যন্ত্র বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য এসব আধুনিক যন্ত্র কেনা হয়েছিল। কবে এসব যন্ত্র চালু হবে, তা স্পষ্ট কেউ জানেন না। যন্ত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের প্রতিবেদন বলছে, নিয়ম মেনে এসব যন্ত্র কেনা হয়নি। এসব যন্ত্রের দাম ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও সাতটি সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনবল উন্নয়ন কার্যপরিকল্পনা থেকে আটটি ‘অ্যাডভান্স ডিজিটাল ডিসেকশান টেবিল’ কেনা হয়েছিল গত বছরের জুন মাসে। এর মধ্যে পাঁচটি যন্ত্রের বাক্স খোলা হয়নি, স্থাপন করা হয়নি, ব্যবহার শুরু হয়নি।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরীর ব্যবচ্ছেদ বা কাটাছেঁড়া শেখার জন্য অ্যাডভান্স ডিজিটাল ডিসেকশান টেবিল ব্যবহার করা হয়। একে ‘ভার্চ্যুয়াল’ মানব শরীরও বলা হয়। শরীরের ভেতর কোথায় কী আছে, তা কম্পিউটারের মাধ্যমে দেখা যায়। আগে মৃত মানুষের শরীর কেটে শিক্ষার্থীরা শিখতেন। এখন এই বিশেষ টেবিল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা শেখেন। শারীরবিদ্যার ক্লাসে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়।
স্বাস্থ্য খাতের টাকায় কেনা মূল্যবান যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী অবস্থায় থেকে নষ্ট হওয়ার অনেক নজির আছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র পড়ে আছে ১২ বছরের বেশি সময়। ক্যানসার চিকিৎসার এই যন্ত্র কেনা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা দিয়ে। ওই যন্ত্র স্থাপনের জন্য যে বিশেষ স্থান ও আয়োজন দরকার, তা খুলনা মেডিকেলে ছিল না বা এখনো নেই। ওই যন্ত্র বাক্স থেকে বের করা হয়নি। যন্ত্রটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ রকম নজির আরও আছে।
গত বছরের ৮ জুন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি অ্যাডভান্স ডিজিটাল ডিসেকশান টেবিল পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি ওই কলেজে গিয়ে দেখা যায়, বাক্সে থাকা যন্ত্রটি প্রশাসনিক ভবনের বারান্দায় রাখা হয়েছে। বাক্স এখনো খোলা হয়নি।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই যন্ত্র ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট জায়গা দরকার। বর্তমানে হাসপাতালে তা নেই।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন কলেজ ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে নতুন ভবনে ওই যন্ত্র স্থাপন করা হবে। তবে কবে নাগাদ নতুন ভবনের কাজ শেষ হবে এবং কবে নাগাদ সেখানে যন্ত্রটি বাক্স থেকে বের করা হবে, তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
একই যন্ত্র পাঠানো হয়েছে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে। যন্ত্রটি বাক্সবন্দী অবস্থায় আছে। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য যে জায়গা ও অবকাঠামো দরকার, বর্তমানে তা নেই। অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে যন্ত্র স্থাপন করা হবে। কবে নাগাদ কাজটি হবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পাবনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ ইবনে আলী প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রটি বাক্সে আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যন্ত্রটি ব্যবহার করা শুরু হবে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এফ এম নুরউল্লাহ জানান, জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না বলে টেবিলটি স্থাপন করা যাচ্ছে না। একই অবস্থায় পড়ে আছে ময়মনসিংহ মেডিকেলে পাঠানো যন্ত্রটি।
তবে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা ও রংপুর মেডিকেল কলেজে যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। ওই তিন কলেজের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা এর ব্যবহার শুরু করেছেন।
সিএজি কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক একটি যন্ত্র কেনা হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা দামে। আটটি কলেজের জন্য আটটি যন্ত্র কেনা হয়েছে ৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দিয়ে। এম এস ওশান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এসব যন্ত্র সরবরাহ করেছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি হয়েছে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো। স্থান ও অবকাঠামো প্রস্তুত করার আগেই যন্ত্র কেনা হয়েছে। কলেজগুলো যন্ত্র ব্যবহারের অবস্থায় আছে কি না, তা আগে যাচাই করা হয়নি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনবল উন্নয়ন কার্য পরিকল্পনা (ওপি) থেকে এসব যন্ত্র কিনে আটটি কলেজে পাঠানো হয়েছে। ওপির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে এসব টেবিলের চাহিদা রয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ কলেজগুলোতে নির্মাণকাজ শেষ করলেই যন্ত্রগুলোর ব্যবহার শুরু হবে।
সিএজি কার্যালয় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এসব যন্ত্র কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে। গত বছরের ১০ অক্টোবর নিরীক্ষক দল ঢাকা ডেন্টাল কলেজ পরিদর্শন করে। নিরীক্ষক দল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ওই যন্ত্র স্থাপনের জন্য কোনো অনুমোদিত স্থান নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাদের ওপর একটি জায়গা ঠিক করেছে, সেখানে সরকারের গণপূর্ত বিভাগ নির্মাণকাজ শেষ করার পর যন্ত্রটি স্থাপন করা হবে।
নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ম আছে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্র কেনার আগে অবকাঠামোগত কাজ শেষ করে নিতে হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। এই যন্ত্র বাক্সে থাকার কথা নয়। এসব যন্ত্র নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
স্বাস্থ্য বিভাগে অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রয়োজন না থাকলেও যন্ত্র কেনা হয়েছে। প্রয়োজন থাকলেও যন্ত্র কেনার সময় সব শর্ত মানা হয়নি। এসব হয়ে থাকে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এ রকম চলে আসছে বছরের পর বছর। আবার দেখা যায়, যত্ন না নেওয়া বা ঠিক সময়ে মেরামত না করার কারণে অনেক যন্ত্র অব্যবহৃত পড়ে থাকে। এর কারণে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত অক্টোবরে প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছিল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ শতাধিক যন্ত্র অচল পড়ে ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব তথ্য সংগ্রহে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে কয়েক হাজার যন্ত্র অচল পড়ে আছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজগুলোর কাজের সমন্বয়ের অভাবে যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছে ও সেগুলো নষ্ট হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বহু বছর ধরে এসব চলছে। যাঁরা যন্ত্র ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত, যাঁরা অনুমোদন দিয়েছেন, যাঁরা ক্রয়ের কাগজপত্রে সই করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে শাস্তি দিতে হবে।
[প্রতিবেদনে তথ্য ও ছবি দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি, পটুয়াখালী, বরিশাল, পাবনা, রংপুর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর]