বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে আসা গোলায় বাইশফাঁড়ি এলাকার নুরুল কবীরের বাড়িতে আগুন ধরে যায়
বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে আসা গোলায় বাইশফাঁড়ি এলাকার নুরুল কবীরের বাড়িতে আগুন ধরে যায়

বিশ্লেষণ

আরাকানে গেরিলাযুদ্ধ কী বার্তা দিচ্ছে

সাগর ও বন্দর মিলিয়ে দক্ষিণ সীমান্ত ঐতিহাসিকভাবে বাংলার সমৃদ্ধির বড় এক উৎস। এই সীমান্ত দিয়ে কালে কালে দুঃসংবাদও এসেছে ঢের। জাপানি আগ্রাসনের মুখে পঞ্চাশের মন্বন্তরের স্মৃতি এখনো গ্রামবাংলার মনে আছে। কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে সীমানায় অস্ত্র হাতে রক্ষী বসিয়ে নির্বিকারও থাকা যায় না।

মাত্র তিন দিন আগে ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে লিখেছিলাম আরাকান থেকে আরও মানুষ আসবে এবং সেটা আগের মতো রোহিঙ্গারা না-ও হতে পারে। এমন অনুমানের কারণ সেখানকার মেঠো পরিস্থিতি। তারপরও গতকাল ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ঘটনাবলিতে বাংলাদেশ বিস্মিত। মিয়ানমারের যুদ্ধে বাংলাদেশের গা বাঁচিয়ে চলার দিন হয়তো শেষ হলো।

কিন্তু বাংলাদেশ কি কেবল শরণার্থী থামানোর কলাকৌশলে আটকে থাকবে? আরাকান আর্মি যদি এ দফায় তাদের সদর দপ্তর রাখাইনে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে বাংলাদেশকে দক্ষিণ সীমান্তে ‘সবকিছু’র জন্য তাদের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। বর্তমান বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রকে এভাবে ‘নন-স্টেট-অ্যাক্টর’দের বিবেচনায় নিতে হয় বাধ্য হয়ে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে আরাকান আর্মির প্রধান ওয়াং ম্রা নাইংয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ই মনে হয়েছিল বামারদের থেকে রাখাইনদের মাতৃভূমি উদ্ধারের সংগ্রাম দ্রুত নতুন উচ্চতায় যাচ্ছে। প্রথম আলোয় সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি। ৪৫ বছর বয়সী নাইংয়ের সাবলীলতা ও আত্মবিশ্বাস দেখে ‘ফরমাল জেনারেল’ এবং ‘গেরিলা নেতা’র ফারাকটা স্পষ্ট ছিল। আলাপের শেষে নাইং অনানুষ্ঠানিকভাবে বলছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলতে চান এবং সেটা উভয়ের স্বার্থে; রোহিঙ্গাদের স্বার্থেও। ঢাকায় সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ‘বন্ধু’কে রাখাইন জেনারেলের সেই বার্তা পৌঁছাতে গিয়ে উত্তর শুনেছি, ‘আমরা এখনো প্রস্তুত নই।’

বলা বাহুল্য, রাখাইন তরুণ গেরিলারা ইতিমধ্যে তাদের ‘অভাবে’র জায়গাগুলো অনেকখানি মিটিয়ে ফেলেছে। জানুয়ারিতে পালেতোয়া দখল করে তারা জানিয়ে দিল ‘সদর দপ্তর’ সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমিতে ফেরার সংগ্রাম হয়তো শিগগিরই পূর্ণতা পাবে। বান্দরবান লাগোয়া পালেতোয়া চিন প্রদেশের শহর হলেও মানচিত্র দেখলে সবাই বুঝবেনÑকাচিন অঞ্চলের গোপন ঘাঁটি থেকে রাখাইন গেরিলাদের আরাকানে ঢুকতে এটা সদর দরজার মতো।

সুতরাং আরাকানজুড়ে পাড়ায়-পাড়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টাচ্ছে এখন। সবুজ গ্রামগুলোতে বাড়ছে গেরিলাদের উপস্থিতি। সংঘাতে মায়ু ও কালাদানের পানি লাল হচ্ছে। গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে আমরা যেটা টের পেলাম, সেটা মংডু, বুথিডং, রাথিডং, আকিয়াব আরও মোটাদাগে টের পাচ্ছে বা পাবে। যুদ্ধ আপাতত উত্তর আরাকানে হলেও তার ফল পুরো আরাকানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। কারণ, গেরিলারা চিন হয়ে ঢুকছে। তাদের লক্ষ্য ম্রাক-উ, আরাকানের পুরোনো রাজধানী, রাখাইনদের আবেগের ধন। ঠিক এ সময়, ‘তাতমা-দ’ নামে পরিচিত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীও পালেতোয়া হারিয়ে পোড়ামাটি নীতি বেছে নিতে পারে। সুতরাং গোলাগুলি এবং মানুষ আরও আসতে পারে নাফের এদিকে।

আরাকানজুড়ে রাখাইন গেরিলা-সুনামি মিজোরাম, মণিপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বহুমাত্রিক চাঞ্চল্য তৈরি করবে। উদ্বাস্তু মানুষের আসা-যাওয়ার বাইরেও ওই চাঞ্চল্যের বাড়তি ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য আছে।

কিন্তু বাংলাদেশ কি কেবল শরণার্থী থামানোর কলাকৌশলে আটকে থাকবে? আরাকান আর্মি যদি এ দফায় তাদের সদর দপ্তর রাখাইনে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে বাংলাদেশকে দক্ষিণ সীমান্তে ‘সবকিছু’র জন্য তাদের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। বর্তমান বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রকে এভাবে ‘নন-স্টেট-অ্যাক্টর’দের বিবেচনায় নিতে হয় বাধ্য হয়ে।

ভারতের জন্যও আরাকানের চলতি ঘটনাবলি বেশ দুর্ভাবনা তৈরি করতে পারে। ভারতভূমির বাইরে আরাকানে রয়েছে তাদের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ প্রকল্প: ‘কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’। বাংলাদেশকে এড়িয়ে জলপথে কলকাতা ও আরাকান হয়ে মিজোরামের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতকে সমৃদ্ধ করার উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পে কলকাতা থেকে আইজলের দূরত্ব নেমে আসতে পারত মাত্র ৯০০ কিলোমিটারে। এখন এ প্রকল্পের ভবিষ্যতের অনেকখানি নির্ভর করবে জেনারেল নাইংয়ের সঙ্গে দর-কষাকষির ওপর। গণচীনেরও এ বিষয়ে নীরবে কিছু বলার থাকবে। আরাকান আর্মি যে মাত্র পাঁচ বছরে ৫ হাজার থেকে জওয়ানসংখ্যা ২০ হাজার করতে পারল, তাতে বেইজিংয়ের সাহায্য-সহায়তা-সহমর্মিতার কিছু প্রতিদান নাইংকে অবশ্যই দিতে হবে। ফলে নতুন আরাকানকে চীন-ভারত ঠান্ডা যুদ্ধের একটা নতুন ফ্রন্ট হিসেবেও দেখা যায়।

আরাকান ও বান্দরবানসংলগ্ন চিন প্রদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিও বেশ উত্তেজক। সেখানে তাতমা-দ প্রায় নাই-ই হয়ে গেছে। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এখানে কেবল নিজেদের নতুন সরকারই গড়েনি, নতুন সংবিধানও তৈরি করেছে। ঘরের কাছের দ্রুত পরিবর্তনশীল এসব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও কি দ্রুত তার এত দিনের মিয়ানমার নীতির সংকট ঘোচাতে সচেষ্ট হবে?

# আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক