গবেষণার ফলাফল

বিদেশে পাচার হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘের হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

বাংলাদেশ থেকে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হয় যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কাতার, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে। সক্রিয় ৩২টি চক্র।

সাতক্ষীরার সুন্দরবনসংলগ্ন একটি গ্রাম থেকে বোতলে ভরা বাঘের হাড়ের গুঁড়া কিনলেন একজন ক্রেতা। সেটি নিয়ে প্রথমে তিনি ঢাকায় এলেন। তারপর বাসে করে সিলেটে। সেখান থেকে একজন উড়োজাহাজে করে সরাসরি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। আরেকজন সিলেট থেকে হাড়ের গুঁড়া নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আসামে চলে গেলেন। শুধু সিলেট নয়, ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিয়মিতভাবে বাঘের হাড়সহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হচ্ছে।

একদল গবেষক দীর্ঘ পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে বাঘ এবং বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালান নিয়ে অনুসন্ধান ও জরিপের মাধ্যমে গবেষণা করেছেন। তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, সুন্দরবনে বাঘশিকারি দস্যুরা এখনো সক্রিয় আছে। বিশ্বের ১৫টি দেশে সুন্দরবনের বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হচ্ছে।

বাঘের চোরাচালান ও পাচারে ১৫৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের ওই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারত, চীন ও মালয়েশিয়ার একদল চোরাচালানকারী। আর এগুলোর সবচেয়ে বড় ক্রেতা কাতার, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো।

বাংলাদেশে অবৈধভাবে বাঘ পাচারের জন্য সুবিধাজনক অবকাঠামো দিন দিন বাড়ছে।
অভিষেক হরিহর, গবেষণার সহলেখক ও প্যানথেরা টাইগার প্রোগ্রামের পরিচালক

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বন্য প্রাণী গবেষণা সংস্থা প্যানথেরা এবং চীনভিত্তিক সংস্থা চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষকেরা যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন। এর ফলাফল চলতি বছর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী কনজারভেশন সায়েন্স ও প্র্যাকটিস-এ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর মিয়ানমার অঞ্চলে ওই বাঘ শিকার ও চোরাচালান চক্রটি সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণাটির প্রয়োজনে ১৯৪ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে; যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাঘ শিকার ও চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।

প্যানথেরার কাউন্টার-ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের দলনেতা ও এই গবেষণার সহযোগী লেখক ড. রব পিকলস বলেন, ‘বিশ্বের বাঘের অবৈধ চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, এই অবৈধ তৎপরতার মোট ১২টি ক্ষেত্র আমাদের গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তৎপর হলে বাঘ হত্যার তৎপরতা আমরা বন্ধ করতে পারি। বাংলাদেশ সুন্দরবনে জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায় সাফল্য পেয়েছে। একটি সফল উদাহরণ বাঘ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহের স্থান, প্রক্রিয়াকরণ এবং সরবরাহ কেন্দ্র, ট্রানজিট বন্দর, অবৈধ সীমান্ত পাড়ি এবং পাচারের স্থানসহ বাণিজ্য পথগুলো চিহ্নিত করেছেন।

তবে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্য প্রাণী পাচার নিয়ে করা ওই গবেষণা আমরা এখনো দেখিনি। এটি দেখে এর সত্যতা যাচাই করব। এ ধরনের পাচারকারী চক্র সক্রিয় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি বাংলাদেশের সুন্দরবন ৩০টি জলদস্যু দল নিয়ন্ত্রণ করত। চাঁদাবাজি, অপহরণ, বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় ইত্যাদি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত সাতটি জলদস্যু দল প্রত্যক্ষভাবে বাঘ শিকারে অংশ নিত। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানেও তারা যুক্ত ছিল। ২০০৯ সালেও সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ ছিল। ২০১৮ সালে তা কমে আনুমানিক ১১৪টিতে নেমে আসে।

বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের জলদস্যুতা প্রতিরোধ অভিযান জলদস্যু গোষ্ঠীগুলোকে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেয়। যারা প্রত্যাখ্যান করে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে অঞ্চলটিকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে জলদস্যুরা চলে যাওয়ার পর তাদের শূন্যস্থান দখল করেছে প্রায় ৩২টি বাঘ চোরাচালানকারী চক্র।

গবেষকেরা বাঘ শিকারের চারটি প্রধান স্থান চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মিয়ানমারের নর্দার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স এবং ভারতের নামদাফা-রয়্যাল মানস পার্ক।

গবেষক দলের প্রধান এবং চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের সাবেক ডক্টরাল ফেলো ড. নাসির উদ্দিন সুন্দরবনে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাঘ চোরাচালানের তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে বাঘ পাচার হয় বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহের স্থান, প্রক্রিয়াকরণ এবং সরবরাহ কেন্দ্র, ট্রানজিট বন্দর, অবৈধ সীমান্ত পাড়ি এবং পাচারের স্থানসহ বাণিজ্য পথগুলো চিহ্নিত করেছেন।

গবেষকেরা বাঘ শিকারের চারটি প্রধান স্থান চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মিয়ানমারের নর্দার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স এবং ভারতের নামদাফা-রয়্যাল মানস পার্ক।

গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বাঘ চোরাচালানের সিংহভাগই ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলসীমান্ত দিয়ে হয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মিল বাঘ চোরাচালানে অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জরিপের সময় বাঘের অংশ পাচারকারী চক্রগুলো মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনেক এলাকায় বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ধনী বাংলাদেশি নাগরিকেরা ঔষধি কাজে, আধ্যাত্মিক উপাদান হিসেবে এবং ঘর সাজানোর শৌখিন পণ্য হিসেবে বাঘের শরীরের অংশবিশেষ যেমন হাড়, কাটা দাঁত, মাংস, দুধ, মাথার খুলি, চামড়া ইত্যাদি ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে দৈহিক শক্তি বাড়াতে অনেকে বাঘের মাংস পর্যন্ত খান। বাঘের দাঁত ও নখ শক্তির প্রতীক হিসেবে এবং খারাপ আত্মাকে তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।

গবেষণার সহলেখক এবং প্যানথেরা টাইগার প্রোগ্রামের পরিচালক অভিষেক হরিহর বলেছেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বাঘ পাচারের জন্য সুবিধাজনক অবকাঠামো দিন দিন বাড়ছে।