রাজধানীর খামারবাড়ি মোড়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ ফ্রিজিংভ্যান থেকে এক কেজি মুরগি, দুই ডজন ডিম ও এক লিটার দুধ কেনেন বেসরকারি চাকরিজীবী তারিক হোসেন।
চাকরিজীবী হয়ে কেন ভ্রাম্যমাণ ফ্রিজিংভ্যান থেকে ‘সুলভ’ মূল্যের এসব প্রাণিজ আমিষ নিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তারিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অবস্থা নিম্নবিত্তের চেয়ে খারাপ। নিম্নবিত্ত মানুষ সংকটে পড়লে রিকশা চালাতে পারে বা অন্য কিছু করতে পারে। আমরা তা পারি না। কিন্তু যা বেতন পাই, তা দিয়ে সংসারও চলে না।’
আজ রোববার সকালে ফ্রিজিংভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে তারিক হোসেন জানান, স্ত্রী, সন্তান, বাবা ও মাকে নিয়ে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসার। বেতন ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু ঘরভাড়াতেই পকেটে থেকে চলে যায় ১৫ হাজার টাকা।
তারিক হোসেন বলেন, ‘কোনো কোনো মাসে খরচ হয়ে যায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। প্রত্যেক মাসেই ঘাটতি থাকে। তাই যেখান থেকে কম দামে জিনিস পাব, সেখান থেকেই কিনব। এ ছাড়া তো উপায় নেই।’
পবিত্র রমজান উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার থেকে ‘সুলভ’মূল্যে রাজধানীর ২০টি স্থানে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তারা ভ্রাম্যমাণ ভ্যানের মাধ্যমে এসব স্থানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৪০ টাকা, খাসির মাংস প্রতি কেজি ৯৪০ টাকা, ড্রেসড (চামড়াছাড়া) ব্রয়লার প্রতি কেজি ৩৪০ টাকা, দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকা ও ডিম প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যে বিক্রি করছে।
খামারবাড়ি মোড়ে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে আজকে এত দামে এসব পণ্য কিনতে নিম্নবিত্তের কাউকে দেখা গেল না। এখানে এসব পণ্য কিনতে আসা সাতজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে চারজন বেসরকারি চাকরিজীবী, একজন সরকার চাকরিজীবী, একজন ব্যবসায়ী ও একজন পেশা জানাতে চাননি। পেশা জানাতে না চাওয়া সেই নারীকে এখান থেকে পণ্য কেনার পর রিকশায় করে ফিরে যেতে দেখা যায়।
উদ্বোধনের দিন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানান, নিম্নবিত্তও যেন রমজান মাসে মাংস খেতে পারে, তাই ব্রয়লার, খাসি ও গরুর মাংস আধা কেজি করে বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। খামারবাড়িতে এসব মাংস আধা কেজি করেও বিক্রি হচ্ছে। তারপরও এত দাম দিয়ে শ্রমজীবী কাউকে এসব পণ্য কিনতে দেখা যায়নি। শ্রমজীবী শ্রেণির এক নারীকে আজ ভ্যানের সামনে দেখা যায়। তিনি জানান, দেখতে এসেছেন। কিনতে নয়।
দুই কেজি ব্রয়লার, দুই লিটার দুধ ও ২০টি ডিম কেনেন সরকারি চাকরিজীবী মিজানুর রহমান। ১৩তম গ্রেডের এই কর্মচারী থাকেন তেজগাঁও এলাকায়। দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তাঁর সংসার। মিজানুর রহমান বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বাসাভাড়া, চিকিৎসাসহ সংসারে অনেক খরচ। সব মিলিয়ে পেরে ওঠা যায় না। তাই এখান থেকে এসব কিনতে আসলাম।’
ছেলেকে স্কুলে দিয়ে স্বামীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে খামারবাড়ি মোড়ে দুধ ও ডিম কিনতে আসেন গৃহিণী নুরে সাবা। তাঁর স্বামী বেসরকারি চাকরি করেন। তাঁদের ছেলে প্রতিদিন দুধ খায়। তাই এখান থেকে ১০ লিটার দুধ ও দুই ডজন ডিম নেন তিনি।
নুরে সাবা জানান, প্রাণিসম্পদের ভ্যান থেকে দুধ ও ডিম কিনে ১৪০ টাকার মতো সাশ্রয় হয়েছে। স্থানীয় বাজার থেকে সেই সাশ্রয় করা টাকা দিয়ে আরও এক ডজন ডিম কিনতে পারবেন, তারপরও ২০ টাকা থাকবে। স্বামী যে বেতন পান, তা দিয়ে টানাটানি। তাই কষ্ট হলেও একটু সাশ্রয়ের চেষ্টা করেন।
অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে দুই ডজন ডিম, দুই লিটার দুধ, দুই কেজি মুরগি ও এক কেজি গরুর মাংস কেনেন বনশ্রীর বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ। তাঁর সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে।
সংসার চলে না দেখে কয়েক বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর বিভিন্ন দোকানে ফল দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বাজারে গিয়ে বাজার করতে পারছি না। তাই সাশ্রয় করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে, রোদে পুড়ে এসব কিনতে হচ্ছে। এই কষ্টের জবাব কে দেবে?’
এ রোজায় আর মাংস কেনা সম্ভব হবে না জানিয়ে নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে একবারে না কিনে অল্প অল্প করে বাজার থেকে কিনতে পারতাম। তা ছাড়া সবার পক্ষে তো এত টাকা খরচ করে একবারে কেনা সম্ভব না।’