‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী চাই’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১০ আগস্ট
‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী চাই’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১০ আগস্ট

রাজনীতি জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি লুটেরা ও সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যাওয়া রাজনীতি জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী চাই’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের আশু ও দীর্ঘ মেয়াদে করণীয় প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। জানানো হয়, এটি প্রাথমিক প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের পাশাপাশি সভায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের আরও প্রস্তাব যুক্ত করেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘বারবার রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ আসবে না। অনেক প্রস্তাব ও কথা আলোচনায় এসেছে। সঠিক কর্মপন্থা তৈরি করতে পারলে কোথাও পৌঁছাতে পারব বলে আশা করছি। জানপ্রাণ দিয়ে প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করব।’

সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি একটাই—ঘাড় ঘুরিয়ে জনগণের দিকে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের ঘাড় লুটেরা ব্যবসায়ী, সম্পদ পাচারকারী ও প্রকল্প বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়াদের থেকে ঘোরানো। এই ঘাড় জনগণের দিকে ঘুরিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায় নিতে হবে। তিনি বলেন, এই সংবিধানের অধীন যে–ই ক্ষমতায় যাবে, সেই স্বৈরাচার হয়ে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানে বড় বদল আনতে হবে।

তিনটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, গত ১৫ বছরে যারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে, সিভিল ও মিলিটারি আমলাতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী—এই তিনটি গোষ্ঠীর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও জনগণের ওপর গুলি চালানো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কী কী করতে চায়, সেটি তুলে ধরলেই তাদের মেয়াদ কত দিন হতে পারে সেটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। যার আদেশে জুলাই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচারের জন্য সরকারকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে।

পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, আগের সরকার অনেক অবৈধ অস্ত্র মানুষের হাতে দিয়ে গেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও যারা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আমলাদের আইনি দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে তানজীমউদ্দিন খান বলেন, অধিকাংশ আইনে যুক্ত করা হয়েছে—কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম হলে দায়মুক্তি পাবেন। তিনি বলেন, মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে চেষ্টা করা হয়েছে, তা স্বাধীন দেশে মেনে নেওয়া যায় না।

সরকারের করণীয় নিয়ে প্রস্তাব

সভায় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব তুলে ধরেন চার শিক্ষক দীপ্তি দত্ত, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, শেহরিন আতাউর খান ও লাবণী আশরাফী। তাতে ৬টি আশু করণীয় এবং ১৩টি দীর্ঘমেয়াদি করণীয় প্রস্তাব করা হয়। আশু করণীয়গুলো হচ্ছে—অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামাতে হবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় তদন্ত কমিটি ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, কোটা আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, সাম্প্রতিক সময়ে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বাতিল এবং শিল্পকারখানা খুলে সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

দীর্ঘমেয়াদি করণীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাগার, পার্ক ও কমিউনিটি সেন্টার চালু, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল, কৃষি খাতের বাজার ব্যবস্থাপনা পুনরুদ্ধার, আমলাতন্ত্র সংস্কার, প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজানো, দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন, বিদ্যমান শিক্ষাক্রম বাতিল, স্বাস্থ্য খাতের নতুন টাস্কফোর্স গঠন, ব্যাংকঋণের বিষয়ে অনুসন্ধান ও নিয়ম ভঙ্গ করে ঋণগ্রহীতাদের বিচার করা এবং সবার জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ।

এই পর্ব সঞ্চালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

সভায় ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। তাতে প্রত্যাশিত সংস্কারের জন্য সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, রাজনৈতিক দল, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারপদ্ধতিসহ ২০টি খাত চিহ্নিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এই খাতগুলোর সমস্যা এবং সংস্কারে আশু ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় বিষয়ে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়।

মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা খাতের সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি, থিয়েটার কর্মী, অধিকারকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ অনেকেই তাঁদের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

এই পর্ব সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।

তাদের দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের মূলধারায় নিয়ে আসা, গণমাধ্যমের নিবর্তনমূলক আইন সংস্কার, হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনমান বাড়ানো, স্বাধীন চলচ্চিত্র কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সংস্কার, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়া সংস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন, গণপরিবহন খাতের সিন্ডিকেট ভাঙা এবং আগের সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ।

মুক্ত আলোচনায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আগের সরকারের নিয়োগ করা ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় বসে আছেন। নিজেদের চাকরি ও পিঠ বাঁচাতে এখন তাঁরা সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।