সময়ের মুখ

সবকিছুতে নিজের লাভ খুঁজলে তো চলবে না

মোসলেম উদ্দিন–এর বয়স এখন ৭৮। এই বয়সেও তিনি প্রতিদিন শৌলমারী নদী ও জীবন নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যান শিশুদের পড়াতে। বিনা বেতনে তিনি কাজটি করছেন ১৫ বছর ধরে। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার দুর্গম চর শৌলমারীর এই শিক্ষকের সাক্ষাৎকার (৮ ও ১১ এপ্রিল) নিয়েছেন আবদুর রব।

মোসলেম উদ্দিন
মোসলেম উদ্দিন
প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি বিনা বেতনে পড়ান। সেটা কেন?

মোসলেম উদ্দিন: আমি শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে পড়াচ্ছি। বেতন-ভাতার কথা ভাবিনি। শিক্ষার্থীরা আমাকে দাদু ডাকে, স্যার ডাকে, মায়া লাগে, আনন্দ পাই। তাই পড়াই। যত দিন শরীর চলে, পড়াতে চাই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি কোন বিষয়ে পড়ান?

মোসলেম উদ্দিন: ইংরেজি। শৌলমারী নদী ও জীবন নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজির একজন শিক্ষক রয়েছেন। তবে তিনি আসেন না। বিদ্যালয়টির পাঠদানের অনুমতি আছে, তবে একাডেমিক স্বীকৃতি নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এই বিদ্যালয়ে পড়ানো শুরুর আগে আপনার পেশা কী ছিল?

মোসলেম উদ্দিন: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছিলাম। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার পর চাকরিটা হয়নি। এরপর চট্টগ্রাম নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছি। একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন বিনা বেতনে প্রধান শিক্ষকের চাকরিও করেছি। একসময় গ্রাম সরকারের সদস্যও ছিলাম। ১৫ বছর ধরে তো শৌলমারী নদী ও জীবন নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?

মোসলেম উদ্দিন: আমি ১৯৬৯ সালে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের হাজরানিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক শাখায় এখনকার এসএসসির সমমানের পরীক্ষায় পাস করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ওই সময় তো গ্রামে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব কম ছিল।

মোসলেম উদ্দিন: আমার গ্রামে সে সময় দুজন এসএসসি (সমমান) পাস মানুষ ছিলেন। একজন আমি, আরেকজন আমার বড় ভাই মনোয়ার হোসেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি যে বিনা বেতনে পড়ান, পরিবারের সদস্যরা কী বলেন?

মোসলেম উদ্দিন: প্রথম দিন থেকেই তাঁরা সমর্থন করছেন। বিশেষ করে আমার স্ত্রী বেনোয়ারা বেগম উৎসাহ দেন। দুই ছেলে বিবাহিত, তাদের পৃথক সংসার। তাদেরও আপত্তি নেই। এই বয়সে আমি তো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দেই আছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনার দুই ছেলেকে কত দূর পর্যন্ত পড়াতে পেরেছেন?

মোসলেম উদ্দিন: আমার দুই ছেলে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছে। গ্রামে তখন উচ্চবিদ্যালয় ছিল না। শৌলমারী চরের বালুর মধ্য দিয়ে হেঁটে ছয় কিলোমিটার দূরে গিয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তে হতো। সংসারে অভাবও ছিল। সব মিলিয়ে লেখাপড়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখন তো উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। আপনি যাঁদের পড়িয়েছেন, তাঁদের কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন কি?

মোসলেম উদ্দিন: অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়েছে। নজরুল ইসলাম, মশিয়ার রহমান, আরিফ হোসেনের নাম মনে পড়ছে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স (স্নাতক) ও মাস্টার্স (স্নাতকোত্তর) করেছে। এটাই আমার আনন্দ।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি স্কুলে পড়ানোর সময় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা বা কথা হয়েছে?

মোসলেম উদ্দিন: সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এসেছিলেন। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক, কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা—অনেকেই এসেছেন। সবাই আমার ক্লাস নেওয়া দেখেছেন। প্রশংসা করেছেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: যে ব্যক্তির বদলে আপনি পড়াচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছে?

মোসলেম উদ্দিন: না। শুনেছি, তিনি অন্য চাকরি করেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত (বেতন–ভাতা বাবদ সরকারি অনুদান) হতে পারেননি। আমি চাই, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখন সংসার চলে কীভাবে?

মোসলেম উদ্দিন: দুই বিঘা জমি থেকে ফসল পাই। পাশাপাশি কয়েকটি শিশুকে বাড়িতে গিয়ে পড়াই। মাসে হাজার তিনেক টাকা আয় হয়। অবশ্য মাঝেমধ্যে কোনো কোনো শিশুর পরিবার টাকা দিতে পারে না। দরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিই না। একসময় আমাদের ৬০ বিঘা জমি ছিল। প্রায় সবই গেছে তিস্তা নদীর পেটে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন কী করবেন?

মোসলেম উদ্দিন: ঈদের নামাজ পড়ে বাড়িতে সেমাই খেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাব। আমার শিক্ষার্থীরা দাওয়াত দিয়েছে। তাদের বাড়িতে যাব।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঈদে নতুন পোশাক কিনবেন না?

মোসলেম উদ্দিন: পরিকল্পনা নেই। প্রথম আলোয় আমাকে নিয়ে ৭ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর কালীগঞ্জের বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবী এস তাবাসসুম রায়হান মুসতাযীর আমার জন্য পাঞ্জাবি আর আমার স্ত্রীর জন্য শাড়ি উপহার দিয়েছেন। সঙ্গে অনেক কিছু দিয়েছেন। এতেই আমরা খুব খুশি। ঈদটা ভালোভাবেই চলে যাবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিনা বেতনে না পড়িয়ে অন্য কাজ করলে কি লাভ হতো?

মোসলেম উদ্দিন: সবকিছুতে নিজের লাভ খুঁজলে তো চলবে না। সমাজের কথা ভাবতে হবে। ছোট্ট শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে।