পাহাড় কাটার অভিযোগে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর আগে করে জরিমানা।
প্রথমে পাহাড় কেটে সমতল করা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় প্লট আকারে।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদের চন্দ্রনগর এলাকায় মামলা, জরিমানার পরও থামেনি দুই আওয়ামী লীগ নেতার পাহাড় কাটা। ‘নাগিন পাহাড়’ নামে পরিচিত পাহাড়টি রেহাই পাচ্ছে না তাঁদের হাত থেকে। এই দুই নেতা হলেন বায়েজিদের জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বাহার উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শামসুদ্দিন।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে নাগিন পাহাড়টি প্রায় ১০ একরের। এতে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়ি ভূমি রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময় প্রায় দেড় একরের মতো পাহাড় কাটা হয়েছে। দিন দিন পাহাড় কাটার পরিধি বাড়ছে। এখন দক্ষিণ পাশের ৩০ শতক (১৮ কাঠা) পরিমাণ একটি অংশ কেটে সমতল করা হচ্ছে। প্রায় ছয় মাস ধরেই এই অংশটি কাটা চলছে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি একটি মামলা করেছে। পরিদর্শক মনির হোসেন বাদী হয়ে এই ২ নেতাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
জানা যায়, ওই মামলায় শামসুদ্দিন ৪ নম্বর ও বাহার উদ্দিন ৮ নম্বর আসামি। ১ নম্বর আসামি মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এই পাহাড়ি ভূমি মনিরের নামে খতিয়ানভুক্ত হওয়ায় তাঁকে আসামি করা হয় বলে জানা যায়।
দুই নেতা হলেন বায়েজিদের জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বাহার উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শামসুদ্দিন।
মামলার পর কয়েক দিন চুপচাপ থাকলেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে পুনরায় তাঁরা পাহাড় কাটা শুরু করেন। কিন্তু তা নজরে আসেনি পরিবেশ অধিদপ্তরের। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ ও মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস গত মঙ্গলবার এলাকাটি পরিদর্শন করেন।
জানতে চাইলে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, পুনরায় পাহাড় কাটার অভিযোগে তাঁদের (১৮ আসামি) নোটিশ দেওয়া হয়। ২২ এপ্রিল তাঁদের শুনানিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এর আগের মামলার তদন্ত চলছে এখনো।
সরেজমিনে গত বুধবার সকালে দেখা যায়, বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের টেক্সটাইল মোড় হয়ে দক্ষিণে গেলে চন্দ্রনগর গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকার সাইনবোর্ড রয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে পাহাড়ি পিচঢালা সড়ক বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। একেবারে শেষ প্রান্তে নাগিন পাহাড়ের অবশিষ্ট অংশ। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একের পর এক ভবন। চন্দ্রনগর কিশোয়ান গলিতে এখন কাটা হচ্ছে নাগিন পাহাড়ের অংশটি। চারদিকে টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে। বেড়ার পাশে টিনের দরজা। ওপরে উঠতেই দেখা যায়, সেখানে তিনটি টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ওই ঘরগুলো মূলত পাহাড় কাটার শ্রমিকদের থাকার জন্য করা হয়। সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগও রয়েছে। কাউকে পাওয়া যায়নি। পাহাড় খাড়াভাবে কাটার চিহ্ন রয়েছে। কাটা অংশ ঢেকে রাখা হয়েছে পলিথিন দিয়ে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ের চূড়া থেকে মাটি কেটে কেটে নিচে ফেলা হয়। মূলত রাতের বেলায় পাহাড় কাটা হয়। এরপর ভোরের মধ্যেই মাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড় কাটার মামলায় যে ১৮ জনকে আসামি করা হয়, তাঁদের মধ্যে শামসুদ্দিন ও বাহারের নেতৃত্বেই এই পাহাড় কাটা চলছে। এর মধ্যে বাহারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে পাহাড় কাটার অভিযোগে অপর একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় একই বছর এপ্রিলে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। আবার ২০২১ সালে চন্দ্রনগর এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে শামসুদ্দিন ও বাহারকে ছয় লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। এই জরিমানার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে আপিল করেন তাঁরা। তবে আপিল খারিজ হয়ে যায়।
পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে বাহার উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। শামসুদ্দিনকে ফোন করা হলে ফোনটি ধরেন তাঁর ছোট ভাই মো. মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বড় ভাই এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। পাহাড় কাটার স্থানে শামসুদ্দিনের একটা জায়গা রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে তাঁর ভাই পাহাড় কাটায় জড়িত নন বলে দাবি করেন মহিউদ্দিন।
জানতে চাইলে জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাদা কাজী মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজনই আমাদের কমিটির পদে আছেন। বাহারের বিরুদ্ধে একটি পাহাড় কাটার অভিযোগ শুনেছিলাম। কিন্তু কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। আমরা ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে। এখন যদি মামলা হয়ে থাকে সেটা আইন অনুযায়ী যা হয় তা হবে।’
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রথমে পাহাড় কেটে সমতল করা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় প্লট আকারে। একেকটি প্লট ২ থেকে ৩ কাঠা পর্যন্ত হয়। প্রতি কাঠার বাজারমূল্য কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলার তদন্ত করছে। এখন নতুন করে পাহাড় কাটার বিষয়ে তারা কোনো অভিযোগ দেয়নি।
নগরের বায়েজিদ থানাধীন নাগিন পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকা। ১৯৯৭ সাল থেকে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি টের পায় ২০২১ সালে। ওই সময় ২৯টি ভবন এবং প্লটের মালিককে জরিমানা এবং ৯ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে। সেই মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে আবাসিক এলাকাটিতে কমপক্ষে ৫০টি প্লট রয়েছে। এতে বেশির ভাগ প্লটে নির্মিত হয়েছে ভবন।
জানতে চাইলে গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আবাসিক এলাকা টিলা থেকে ভিটা হিসেবে নকশাও অনুমোদন করা হয়। এখন নতুন করে কেউ পাহাড় কাটলে তার দায় আমরা নেব না।’
এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রামে পাহাড় রক্ষা করা যাবে না বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশ গিয়ে পাহাড় কাটায় জড়িতদের ধরছে না কেন? পাহাড় কাটায় নিয়োজিত শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করে লাভ নেই। মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। এসব পাহাড়খেকোর কারণে নাগিন পাহাড় দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।