চালুর জন্য প্রস্তুত চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সম্প্রতি লালখানবাজার এলাকায়
চালুর জন্য প্রস্তুত চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সম্প্রতি লালখানবাজার এলাকায়

চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচলে আরও ২ মাসের অপেক্ষা 

উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পার। এখনো নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কিছু কাজ বাকি। 

উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পরও যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত এই এক্সপ্রেসওয়ে গাড়ি চলাচলে আরও অন্তত দুই মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ আগস্ট মাসে গাড়ি চলাচল শুরু হবে, এমনটা বলছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের মার্চে গাড়ি চলাচল শুরুর কথা জানিয়েছিল সংস্থাটি। 

সিডিএ জানায়, মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কিছু কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। সংস্থাটির পরিকল্পনা ঘাটতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি চট্টগ্রাম নগরের ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’-এর উদ্বোধন করেছিলেন।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই দফা সময় বৃদ্ধি করে মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। এ সময়ে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। কিন্তু বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। এখন আরেক দফা সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করার জন্য আবেদন করেছে সংস্থাটি। 

যে কারণে এখনো অপেক্ষা

সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। তখন থেকে যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যায় এক্সপ্রেসওয়ে। কিন্তু সড়কবাতি, ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপনের কাজ বাকি রয়েছে। 

এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনের সময় টোল আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু মূল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দরপত্র দিলেও সেখানে টোল প্লাজার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। ছিল না সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজও। নির্মাণকাজের শেষ পর্যায়ে এসে গত বছরের এপ্রিলে এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণ এবং টোল প্লাজা স্থাপনের জন্য দরপত্র দিয়েছিল। কিন্তু টোল প্লাজা স্থাপনের দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। টোল প্লাজার জন্য আবার নতুন করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করে সিডিএ। 

সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান র‍্যাঙ্কিন লিমিটেড। 

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ করেছেন দুই মাস আগেই। কিন্তু সিডিএর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এক্সপ্রেসওয়েতে সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় গাড়ি চলাচলে রাজি ছিল না। কেননা এতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটলে তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যাবে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি সড়কবাতি লাগানো হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে ৬০০টি। বাকি ৭০০ বাতি চলতি মাসে দেশে আসার কথা রয়েছে। আর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশে ২০০টি শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। তাইওয়ান থেকে এসব ক্যামেরা আসতে অন্তত দেড় মাস লাগবে। 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সিডিএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো না করে যদি গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? তবে এসব কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। 

শেষ মুহূর্তে মেয়াদ বাড়ছে এক বছর

১৫ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশে ১৫টি র‍্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) রয়েছে। ১৫টি র‍্যাম্পের মধ্যে জিইসি মোড়ের পেনিনসুলা হোটেলের সামনে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকির হাটে একটি, নিমতলায় দুটি, চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি, কর্ণফুলী ইপিজেডে দুটি, সিমেন্ট ক্রসিংয়ে একটি করে র‍্যাম্প থাকবে।

এসব র‍্যাম্পের নির্মাণকাজ গত ৩০ জুন শেষ করার কথা ছিল সিডিএর। কেননা এদিন ছিল প্রকল্পের মেয়াদের শেষ দিন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে টাইগারপাসের দুটির মধ্যে একটি র‍্যাম্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আর মাত্র চারটি র‍্যাম্পের নির্মাণকাজ শুরু করতে সক্ষম হয় সিডিএ। এগুলো হচ্ছে জিইসি মোড়ে একটি, ফকিরহাটে একটি এবং নিমতলায় দুটি। বাকি ১০টির কাজ এখনো শুরু হয়নি। ইতিমধ্যে নগরের টাইগারপাস ও আগ্রাবাদে র‍্যাম্প নির্মাণে বিরোধিতার মুখে পড়েছে সিডিএ।

উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পরও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে না দেওয়ার পেছনে সিডিএর পরিকল্পনা-ঘাটতিকে দায়ী করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পরও প্রকল্প ব্যবহার উপযোগী না হওয়া দুঃখজনক। আমাদের এখানে নির্মাণকাজ শুরুর পর মাঝামাঝি সময়ে কাজের সংযোজন-বিয়োজন চলে। এতে প্রকল্পের মেয়াদ যেমন বাড়ে, তেমনি ব্যয়ও বাড়ে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে মানুষ নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, একই সঙ্গে নির্মাণকাজের জন্য দুর্ভোগও পোহাতে হয়।’