অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা সবগুলো সংস্কার কমিশনে নারী প্রতিনিধিদের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরতে বলেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, কোথায় কোথায় বৈষম্য আছে, বৈষম্য কমাতে কী করতে হবে—সেগুলো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আকারে কমিশনের কাছে তুলে ধরতে হবে।
আজ সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে অধ্যাপক রওনক জাহান এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও নারী’ শিরোনামে এ বৈঠকটি মহিলা পরিষদের নিজ কার্যালয় সুফিয়া কামাল ভবনের আনোয়ারা বেগমÑমুনিরা খান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ছাড়াও অন্যান্য সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রমিক অধিকার এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
বৈঠকে চাকরিতে নারী কোটার প্রসঙ্গ টেনে রওনক জাহান বলেন, নারীদের ভাবতে হবে কোটা রাখার দরকার নেই, নাকি কোনো জাতিসত্তার জন্য কিছু কোটা রাখা দরকার? সংসদে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাবের বিষয়ে বড় নারী সংগঠনগুলোকে এক হয়ে অভিন্ন প্রস্তাব দিতে বলেন তিনি। পাশাপাশি নারীদের দাবি আদায়ে নাগরিক কমিটিতে থাকা নারীদের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দেন।
নারী নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রওনক জাহান বলেন, ‘নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নারীকে হয়রানি করার বড় জায়গা হয়ে উঠেছে। শুনেছি, কিছু মেয়ে রাস্তায় হয়রানির শিকার হচ্ছে। মেয়েদের পোশাক নিয়েও হয়রানি করা হচ্ছে।’ এসব কতখানি সত্য সেটি মহিলা পরিষদকে খুঁজে দেখতে বলেন তিনি।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম। সেখানে বলা হয়, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড) প্রণয়ন করতে হবে। সাময়িক সময়ের জন্য সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে উন্নীত করে সেখানে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখতে হবে। ’৭২–এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল এবং মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করেই অগ্রসর হতে হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, দেশে অনেক আইন রয়েছে। তবে তার প্রয়োগের অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। আইনের প্রয়োগের অভাবে ভুক্তভোগী পালিয়ে বেড়ায়, আর আসামি ঘুরে বেড়ায়। তিনি ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার আহ্বান জানান।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত বলেন, ‘পারিবারিক আইনে বৈষম্য আছে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তা না করা গেলে সংস্কারের মাধ্যমে সংশোধনের প্রক্রিয়ায় গেলে তা কার্যকর হবে না।’
আলোচক হিসেবে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাকসুদা আক্তার লাইলী এবং বাংলাদেশ ইউনির্ভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) আইন বিভাগের শিক্ষক ইমরান আজাদ।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে মূল বাধা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা। সংবিধানে নারীর যতটুকু আইনি অধিকার রয়েছে, সেই অধিকারটুকু পাওয়া যায় না আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায়। নারীর অংশীদারত্বের স্বীকৃতি না থাকায় ব্যক্তিগত অধিকার প্রাপ্তিতে ঘাটতি রয়েছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়ার বিষয়গুলো সংবিধানে সুরক্ষিত রাখার ওপর তিনি জোর দেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বৈঠক সঞ্চালনা করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।