সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করেছে সরকার। পরীক্ষার ফলাফল কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সরকারের এ সিদ্ধান্তের পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ফলাফলের বিষয়ে আজ বুধবার বেলা ১১টায় সব কটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
এ বৈঠক থেকে সুপারিশ তৈরি করে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে। সরকার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিলের বিষয়টি তাঁরা সমর্থন করেন না।
এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৪ লাখের মতো। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখনো পর্যন্ত ছয়টি পরীক্ষা বাকি ছিল। ব্যবহারিক পরীক্ষাও হয়নি।
এরই মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে। যদিও সেটা হয়নি। কারণ হিসেবে শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দিন বিভিন্ন এলাকায় থানায় হামলা হয়েছিল। এতে থানায় রাখা প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য ১১ আগস্টের পরিবর্তে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
কিন্তু আন্দোলনকারী পরীক্ষার্থীদের দাবি ছিল, অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হবে। তাঁরা বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তাঁদের মানসিক চাপে ফেলেছে। এ ছাড়া কোটা আন্দোলনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত নন। অনেক সহপাঠী আহত, হাসপাতালে ভর্তি। এ অবস্থায় তাঁরা স্থগিত পরীক্ষাগুলো আর দিতে চান না। ইতিমধ্যে হওয়া পরীক্ষা এবং স্থগিত বিষয়ে এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে (ম্যাপিং) এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করার দাবি জানান তাঁরা। এ দাবিতে গত সোমবারও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেছিলেন পরীক্ষার্থীরা।
সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ
দাবি আদায়ে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ের সামনে আসেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সচিবালয়ের পূর্ব দিকের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন তাঁরা।
সচিবালয় রাষ্ট্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর (কেপিআই) একটি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই সচিবালয় থেকে মূলত দেশ পরিচালিত হয়। তাই সচিবালয়ে ঢুকতে গেলে বিশেষ পাসের (অনুমতিপত্র) প্রয়োজন হয়।
একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনের নিচে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, ‘দাবি মোদের একটাই, পরীক্ষা বাতিল’ পরীক্ষা না বিকল্প? বিকল্প বিকল্প’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় সেখানে পুলিশ ছিল।
এর আগে দুপুরে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এইচএসসি ও সমমানের বাকি পরীক্ষাগুলো অর্ধেক প্রশ্নোত্তরে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে আগে যদি আটটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো সেখানে চারটির উত্তর দিলে হবে। এ ছাড়া সংশোধিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা ১১ সেপ্টেম্বর থেকে আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা এমন সিদ্ধান্ত মানেননি। তাঁরা দাবি পূরণে এক ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের ১৮ তলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উঠে যান। শিক্ষার্থীরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের দপ্তরসহ এখানে-সেখানে অবস্থান নেন। কাছাকাছি সময়ে নিচে থাকা শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সচিবালয়ের সব প্রবেশপথ আটকে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দর্শনার্থীরা সচিবালয়ের ভেতরে আটকা পড়েন।
এ পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের দপ্তরের সামনে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতিও। এ সময় সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এ জন্য তাঁরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছেন। আলোচনা সাপেক্ষে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে কর্মকর্তারা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরে তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। এখন ফলাফল কীভাবে দেওয়া হবে, তা পরে ঠিক করা হবে।
এরপর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে লিখিত আদেশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, অনিবার্য কারণে বাকি থাকা এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে।
দাবি পূরণের ঘোষণা দেওয়ার পর সচিবালয়ে ঢাকা কলেজের একজন পরীক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি। কারণ, আমরা চাইছিলাম এর একটি যৌক্তিক সমাধান হোক। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করলে আরও খুশি হব।’
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না হওয়ায় সবাই পাস করেন। তখন এসএসসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের গড় মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল।
এবারের স্থগিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো না হওয়ার বিষয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া গেছে শিক্ষাবিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার মাঝখানে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই এ বিবেচনায় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। এখন ভিন্ন ব্যবস্থায় ফলাফল প্রকাশের সময় দেখতে হবে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তবে স্থগিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো নজির হবে না বলে মনে করেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে শিক্ষার্থীদেরই ভুগতে হবে। তাই কষ্ট হলেও পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। সরকারেরও পরীক্ষাটি নেওয়া দরকার ছিল।