ব্যালটের ভোটে সুই-সুতা থেকে কত–কী যে লাগে

ব্যালট বাক্স
প্রতীকী ছবি

নির্বাচন যদি ব্যালটে হয়, সে ক্ষেত্রে ভোটার গোপন বুথে যান। ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রতীকে সিল দেন। সিল দেওয়া পেপার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ফেলেন। ভোটার যে ভোট দিয়েছেন, তা চিহ্নিত করতে তাঁর আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ দেওয়া হয়।

আপাতদৃষ্টে ব্যালটে ভোটের জন্য ব্যালট পেপার, সিল, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালি—এগুলো লাগে। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, কাগজের ব্যালটে ভোট নিতে আরও অনেক জিনিসের দরকার পড়ে।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যালটে ভোটের কাজে সুই, সুতা, মোমবাতি, দেশলাই থেকে শুরু করে অন্তত ২৩ ধরনের জিনিসের দরকার হয়। এ ছাড়া বিশেষ খামসহ ১৭ ধরনের প্যাকেটের প্রয়োজন হয়।

জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় ইসির যে নির্দেশিকা আছে, সেখানেও ব্যালটের ভোটের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় এসব জিনিসপত্রের বিবরণ আছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের সব কটিতেই কাগজের ব্যালটে ভোট হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই হবে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। তবে এই নির্বাচনে ভোট কীভাবে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ইসি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম একসঙ্গে কিনছে। কিছু জিনিস ইসি সচিবালয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে কেনা হচ্ছে। আর কিছু জিনিস কেনা হবে স্থানীয়ভাবে।

ইসির খসড়া তালিকা অনুযায়ী, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র হবে ৪২ হাজার ৩৮০টি। ভোটকক্ষ হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮টি।

নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হয়। আর প্রতি কেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দেওয়া হয়। সে হিসাবে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩ লাখের বেশি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হবে।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, কমিশনের কাছে এখন বেশ কিছু স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৭৫ হাজারের মতো নতুন স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স কেনা হচ্ছে।

ভোটের সময় ভোটার তালিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য ছবিসহ ভোটার তালিকার দুটি কপি দরকার হয়। ভোট দিতে ব্যালট পেপার লাগে। একটি ভোটকেন্দ্রে যতজন ভোটার, ততটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। ইসির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো মুদ্রণের কাজ করে সরকারি মুদ্রণালয়।

একই ভোটার যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারেন, সে জন্য ভোট দেওয়ার পর তাঁর হাতের আঙুলে কালির ছাপ দেওয়া হয়। এই ছাপ অমোচনীয় কালির কলম দিয়ে দেওয়া হয়।

সাধারণত প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে অমোচনীয় কালির কলম দেওয়া হয়। আর প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য অতিরিক্ত দুটি করে অমোচনীয় কালির কলম বরাদ্দ করা হয়। সে হিসাবে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রায় সাড়ে তিন লাখ অমোচনীয় কালির কলম প্রয়োজন হবে। তবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এখন একসঙ্গে প্রায় ৮ লাখ অমোচনীয় কালির কলম কেনা হচ্ছে।

নির্বাচনের কাজে তিন ধরনের সিল প্রয়োজন হয়। এর একটি হলো রাবারের সিল (অফিশিয়াল সিল)। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি অফিশিয়াল সিল প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত একটি করে অফিশিয়াল সিল সরবরাহ করা হয়।

আরেকটি হলো মার্কিং সিল। এই সিল দিয়ে ভোটার ব্যালট পেপারে তাঁর পছন্দের প্রতীকে ভোট দিয়ে থাকেন। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য দুটি করে মার্কিং সিল প্রয়োজন হয়। আর প্রতি কেন্দ্রের জন্য অতিরিক্ত দুটি করে মার্কিং সিল সরবরাহ করা হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচনে মার্কিং সিল লাগবে ছয় লাখের বেশি।

অফিশিয়াল ও মার্কিং সিল রাবারের হয়। এর বাইরে আরেকটি সিল প্রয়োজন হয়, যেটি পিতলের তৈরি। পিতলের এই সিলমোহরকে ব্রাশ সিলও বলে। সিলগালা লাগানোর জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য একটি করে পিতলের সিল লাগে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় ৯০ হাজার পিতলের সিল কেনা হবে।

রাবারের সিলের জন্য প্রয়োজন হয় স্ট্যাম্প প্যাড। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্ট্যাম্প প্যাড লাগে। এ ছাড়া প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত স্ট্যাম্প প্যাড দেওয়া হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই স্ট্যাম্প প্যাড লাগবে তিন লাখের বেশি।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ১৪ লাখ সিল (অফিশিয়াল ও মার্কিং) কেনা হচ্ছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

স্ট্যাম্প প্যাডের জন্য লাগে কালি। এই কালি স্থানীয়ভাবে কেনা হয়।

ভোট গণনার কাজ শেষ হওয়ার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা চটের ব্যাগে সব প্যাকেট ও দলিলপত্র ভর্তি করে সিলগালা করেন। এ জন্য প্রয়োজন হয় গালা।

প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য ২০০ গ্রামের এক প্যাকেট করে গালা প্রয়োজন হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় ৯০ হাজার প্যাকেট গালা কেন্দ্রীয়ভাবে কেনা হচ্ছে।

গালা লাগাতে প্রয়োজন হয় আগুন। সে জন্য লাগে মোমবাতি, দেশলাই।

ইসি সূত্র জানায়, একসময় যখন সবখানে বিদ্যুৎ ছিল না, তখন ভোটকেন্দ্রগুলোতে হারিকেন ব্যবহার করা হতো। আলো দেওয়ার পাশাপাশি এই হারিকেন গালা গলানোর কাজে ব্যবহার করা হতো।

ইসির কর্মকর্তারা বলেন, এখন আর ভোটকেন্দ্রে হারিকেনের দরকার পড়ে না। দেশের প্রায় সব ভোটকেন্দ্রেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তবে বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের কথা মাথায় রেখে বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হয়। একসময় হারিকেন ছিল বিকল্প। সময়ের ব্যবধানে হারিকেনের জায়গা দখল করে নেয় চার্জার লাইট। এখন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য একটি করে চার্জার লাইট দেওয়া হয়।

চার্জার লাইট দিয়ে আলোর ব্যবস্থা হলেও আগুনের ব্যবস্থা হয় না। এ জন্য গালা গলাতে প্রয়োজন মোমবাতি। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য বড় আকারের ছয়টি করে মোমবাতি দেওয়া হয়। মোমবাতি জ্বালাতে লাগে দেশলাই। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি করে দেশলাই দেওয়া হয়। মোমবাতি ও দেশলাই কেনা হয় স্থানীয়ভাবে।

ব্যালটসহ ভোটের বিভিন্ন দলিল সিলগালা করার আগে সেগুলো বস্তায় ভরা হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় চটের থলে (বড় হেসিয়ান ব্যাগ)। মনিহারি দ্রব্যাদি বহনের জন্য প্রয়োজন হয় ছোট চটের থলে।

থলের মুখ সেলাই করার জন্য দরকার হয় সুই-সুতা। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি করে বড় আকারের সুই ও সুতার একটি ছোট বল সরবরাহ করা হয়। আগামী নির্বাচনে ৪২ হাজারের কিছু বেশি সুই ও ৪২ হাজারের বেশি সুতার বল প্রয়োজন হবে। এগুলো কেনা হবে স্থানীয়ভাবে।

ভোটের হিসাবের কাজে ভোটকেন্দ্রে প্রয়োজন হয় ক্যালকুলেটর। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি করে ক্যালকুলেটর দেওয়ার নিয়ম আছে। তবে যেহেতু সব কর্মকর্তার কাছেই মুঠোফোন থাকে, আর মুঠোফোনে ক্যালকুলেটর থাকে, সেই বিবেচনায় এবার ক্যালকুলেটর না-ও দেওয়া হতে পারে বলে ইসি সূত্র জানায়।

আবার বিভিন্ন কাগজ স্টাপলিংয়ের জন্য লাগে স্টাপলার ও স্ট্যাপলারের পিন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য একটি করে স্ট্যাপলার ও এক প্যাকেট করে স্ট্যাপলার পিন বরাদ্দ করা হয়।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজন হয় কলম। প্রত্যেক ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার জন্য একটি করে কলম দেওয়া হয়। আর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্য কর্মকর্তার জন্য একটি করে কলম দেওয়া হয়।

এবার প্রায় ৯ লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার প্রয়োজন হবে। সে হিসাবে প্রায় ৯ লাখ বলপয়েন্ট কলম লাগবে ভোটের কাজে। এই কলমগুলো কেনা হবে স্থানীয়ভাবে।

এ ছাড়া প্রয়োজন হয় সাদা কাগজ, কার্বন কাগজ, ছুরি, গামপট, গ্লু, মুড়িপত্র থেকে ব্যালটের কাগজ আলাদা করার জন্য লোহা বা প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ পাত। এই জিনিসগুলো কেনা হবে স্থানীয়ভাবে।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এসবের বাইরে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য ১৭ ধরনের খাম বা প্যাকেট লাগে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষে পড়া বৈধ ব্যালট পেপার রাখার জন্য প্রার্থীপ্রতি একটি করে প্যাকেট লাগে (প্যাকেট-১)। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কে কত বৈধ ভোট পেয়েছেন, সে ব্যালট এই প্যাকেটে আলাদা আলাদা করে রাখা হয়।

গণনা থেকে বাদ দেওয়া বা বাতিল ভোটের ব্যালট পেপারগুলো রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-২)। প্যাকেট-১ ও প্যাকেট-২ আবার একসঙ্গে রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-৩)।

যে ব্যালট পেপারগুলো ব্যবহৃত হয় না, সেগুলো রাখার জন্য প্রয়োজন হয় আরেকটি প্যাকেট (প্যাকেট-৪)। নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যালট পেপারগুলো রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-৫)।

টেন্ডার্ড ব্যালট পেপার রাখা হয় আলাদা আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-৬)। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ এমন প্যাকেটের সংখ্যা ১০। টেন্ডার্ড ব্যালট পেপার হলো, কোনো ভোটার ব্যালটের জন্য গিয়ে যদি দেখেন অন্য কেউ তাঁর ভোট দিয়ে চলে গেছেন, তখন তাঁকে একটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। তবে তিনি ভোট দিয়ে এই পেপার ব্যালট বাক্সে ফেলতে পারবেন না। তিনি পেপারটি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে দেবেন। আবার ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থীর টেন্ডার্ড ব্যালটগুলো একসঙ্গে একটি প্যাকেটে রাখা হয় (প্যাকেট-৭)।

আপত্তিকৃত ভোট রাখার জন্য থাকে আলাদা আরেকটি প্যাকেট (প্যাকেট-৮)।

চিহ্নিত ভোটার তালিকার কপিগুলো রাখার জন্য লাগে আরেকটি প্যাকেট (প্যাকেট-৯)। ব্যবহৃত ব্যালট পেপারের মুড়িপত্র রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-১০)।

টেন্ডার্ড ভোটের তালিকা রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-১১)। আরেকটি প্যাকেটে রাখা হয় ইস্যুকৃত ও ব্যবহৃত স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের বিবরণী (প্যাকেট-১২)।

প্যাকেট-১৩-তে রাখা হয় আপত্তিকৃত ভোটার তালিকা। ভোট গণনার হিসাব রাখা হয় একটি প্যাকেটে (প্যাকেট-১৪)।

ব্যালট পেপারের হিসাব রাখা হয় আরেকটি প্যাকেটে (প্যাকেট-১৫)। অন্যান্য কাগজপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় আরেকটি প্যাকেট (১৬)।

এর বাইরে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য দুটি করে বিশেষ খাম লাগে। ভোটকেন্দ্র থেকে সরকারি ডাকযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ভোট গণনার বিবরণী পাঠানোর জন্য এই খাম লাগে।

ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে অনেক জিনিসপত্রের প্রয়োজন হয়। কিছু জিনিস ইসি সচিবালয় সরবরাহ করে। কিছু জিনিস প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কেনা হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির এসব কেনাকাটার কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। যা বাকি আছে, তা কেনার কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে।