‘নতুন বাংলাদেশ: দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
‘নতুন বাংলাদেশ: দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

একই ব্যক্তিকে সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান না করার সুপারিশ টিআইবির

একই ব্যক্তি যেন একই সঙ্গে সরকারপ্রধান (প্রধানমন্ত্রী), দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকতে না পারেন সেই সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একজন ব্যক্তি যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, সেই সুপারিশও করেছে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থাটি।

‘নতুন বাংলাদেশ: দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ–সংক্রান্ত বিস্তারিত সুপারিশ তুলে ধরে টিআইবি। আজ বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এর আয়োজন করা হয়।

নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্তভাবে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ওই দুটি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এর পাশাপাশি স্পিকারকে সংসদের অভিভাবক হিসেবে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করার প্রস্তাবও দিয়েছে তারা। এ ছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের (অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট ছাড়া) সমালোচনা করা ও দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলে দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র বিলোপ করার কথাও বলেছে টিআইবি।

আজকের অনুষ্ঠানে এসব সুপারিশ তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, টিআইবি সরকারকে সহায়তা করার লক্ষ্য নিয়ে এসব সুপারিশ তৈরি করেছে। ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীন রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটে। একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের জায়গায় আরেকটি কর্তৃত্ববাদী শাসন যেন না আসে সেদিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে ছাত্র–জনতার প্রত্যাশা পূরণ হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ছাত্র–জনতার মূল প্রত্যাশা একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো ও পরিবেশ তৈরি করা।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও নীতি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান, একই বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো শাহাজাদা এম আকরাম ও মোহাম্মদ জুলকারনাইন এবং প্রচার ও যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বিগত সরকার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি বলে অর্থ ফেরত আসেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য আজ যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে তাদের কতটুকু সময় লাগবে সেটা বলা সম্ভব নয়। সেটা তাঁরা নির্ধারণ করতে পারবেন। প্রত্যাশা পূরণের যে জনরায় নিয়ে এ সরকার এসেছে, তার জন্য যতটুকু সময় দরকার তা তাদের দেওয়া উচিত।

হত্যা মামলায় হুকুমের আসামি করা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নজিরবিহীন যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এটা এড়িয়ে যেতে পারে না। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু করা দরকার। এ বিষয়ে জোরোলো নজর দেওয়া উচিত। সরকার জাতিসংঘের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছে। তাদের আলোচনায় মনে হয়েছে, এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, কারা দায়ী, তা দ্রুত চিহ্নিত করে নিশ্চিত করা হোক।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ছাত্র–জনতার এ অভ্যুত্থান থেকে যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁরা জমি দখলের মতো দখলদারির দিকে চলে গেছেন। বিভিন্ন ধরনের অসমতাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারারও বিকাশ হচ্ছে, এটাও আশংকাজনক। তিনি বলেন, সরকার দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র ২০ দিন। এত দ্রুত মূল্যায়ন করা যায় না। ধ্বংসস্তূপের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে চর্চা ছিল, তার পরিবর্তন এখনো হয়নি। চট করে পরিবর্তন আশাও করা যায় না। আদালতে অরাজকতা দেখা যাচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় মামলা করা হচ্ছে তা হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য করা হচ্ছে কি না, দেখা দরকার। ছাত্র–জনতা যেখানে যেতে চায়, সে পথ আরও বহু দূরে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচনকেন্দ্রিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। তিনি বলেন, 'এই সরকারের প্রতি আমরা খুব সহানুভূতিশীল। তাঁদের হাতে যাদুর কাঠি নেই যে চট করে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে পারবে।' 

আরও যেসব সুপারিশ

টিআইবির সুপারিশে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। এই রূপরেখায় দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র বিলোপ করতে হবে এবং দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে তরুণ, নারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বিচার বিভাগে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন ও কার্যকর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বাধীন সচিবালয়ের ওপর ন্যস্ত করা, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে বিচারপতি অপসারণের এখতিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করাসহ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

ছাত্র–জনতার আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনিয়ম–দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে।  সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার জন্য ঢেলে সাজাতে হবে।

সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বন্ধ করার পক্ষে টিআইবি। তারা বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ ও নজরদারি বন্ধ করতে হবে।

‘বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬’–এর ধারা ১৪ এবং ‘আয়কর আইন ২০২৩’–এর ধারা ২ (৩১চ) বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ ধারাগুলো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিশেষ করে মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩’ বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার চর্চা বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং প্রকৃত গণমাধ্যম হিসেবে পেশাগত সক্ষমতা ও সংস্কৃতি বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

অনিয়ম–দুর্নীতি প্রতিরোধ ও অর্থ পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে সম্পৃক্ত করে স্থায়ী টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

টিআইবির প্রস্তাব, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে খসড়া ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন’–এ প্রস্তাবিত বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করতে হবে। বহুমুখী মানবাধিকার হরণের হাতিয়ার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে ঋণ জালিয়াতি, প্রতারণা ও অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’ বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে টিআইবি। তারা বলেছে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল করতে হবে।