চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়ম মেনেই সব করতে চেয়েছিলেন মো. গোলাম ইয়াজদানী। কিন্তু ঠিকাদারদের একটি দল চেয়েছিলেন ভাগাভাগি করে নিতে। এ জন্য করেছিলেন তদবিরও। কিন্তু তা মানেননি প্রকল্প পরিচালক। এতে প্রথম ধাপের ২২০ কোটি টাকার কাজেই নিয়মের কড়াকড়িতে বাদ পড়তে যাচ্ছেন বেশ কয়েকজন ঠিকাদার। এটা জেনেই জোট বেঁধে প্রকল্প পরিচালকের ওপর হামলা চালালেন ঠিকাদারেরা। যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক।
প্রায় ১৫ জনের একটি দল রোববার বিকেলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর কার্যালয়ে ঢুকে তাঁকে মারধর করেন। এই সময় তাঁর টেবিলের কাচ ও নামফলকও ভেঙে ফেলা হয়। সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন। এর আগে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের সময় ২০১১ সালে বিলবোর্ড অপসারণকে কেন্দ্র করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দরজায় লাথি মেরেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ওই সময় বিলবোর্ড অপসারণের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদেরও মারধরের ঘটনা ঘটেছিল।
রোববার যাঁরা হামলা চালালেন, তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপি সমর্থক মো. সাহাবুদ্দিন। এই দলে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক পাঠাগার সম্পাদক সঞ্জয় ভৌমিক ওরফে কংকন এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ফেরদৌস, সুভাষ ও হাবিব ছিলেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন গোলাম ইয়াজদানী। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয় গত বছরের ৪ জুন।
এই প্রকল্পের আওতায় গত বছরের নভেম্বরে ২২০ কোটি টাকার ৩৭টি লটের দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শেষ হয় ২৭ ডিসেম্বর। দরপত্র উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনো কাউকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। তবে কারা কাজ পাচ্ছে, আর কারা কাজ পাচ্ছেন না, তা এরই মধ্যে জেনে ফেলেছেন ঠিকাদারেরা।
কাজ পাচ্ছেন না, এমন দুজন ঠিকাদার অভিযোগ করেছেন, ৩৭টি উন্নয়নকাজের মধ্যে রুকনউদ্দিন নামের এক ঠিকাদারের ইকবাল অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২২টি, আলাউদ্দিন মোল্লার ডি-কনস্ট্রাকশন ট্রেড নামের প্রতিষ্ঠান আটটি এবং কাশেম কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান চারটি কাজ পেতে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী বা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামে আড়াই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প নিয়ে প্রথম আলোচনা হয়েছিল ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ওই দিন হঠাৎ করেই জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। করপোরেশনের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে হাজির হয়েছিলেন নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা। উপস্থিত ছিলেন নগরের পতেঙ্গা এলাকার শিল্পগ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নগরের বিমানবন্দর সড়ক সম্প্রসারণের ইচ্ছা পোষণ করে সবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। এ জন্য বড় একটি প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
গত বছর একনেকে অনুমোদনের পর থেকে এই প্রকল্প ঘিরে ঘটতে থাকে একের পর এক নাটকীয়তা। প্রথমে প্রকল্পের পরিচালক হতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়নি। বিকল্প প্রকল্প পরিচালকের নাম পাঠাতে বলা হয়। এরপর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদাত মোহাম্মদ তৈয়বকে মনোনীত করে সিটি করপোরেশন। গত বছরের ১৪ জুলাই তাঁকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় এক মাস পর গত বছরের ১১ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে তাঁকে প্রকল্প পরিচালক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত বছরের ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো প্রকৌশলীকে দায়িত্ব না দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়। এরপর গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর এলজিইডি থেকে জারি করা অফিস আদেশে বলা হয়, প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানী সপ্তাহে দুই দিন সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করবেন।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী বুধ ও বৃহস্পতিবার অফিস করেন। বাকি কর্মদিবসগুলোতে ঢাকায় এলজিইডি কার্যালয়ে অফিস করেন। আর রোববার চট্টগ্রামে এসেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় অংশ নেওয়ার জন্য। সাধারণ সভায় আন্দরকিল্লার পুরোনো নগর ভবন থেকে টাইগারপাসে অবস্থিত অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ে নিজ দপ্তরে যাওয়ার পর ঠিকাদারদের হামলার শিকার হন তিনি।
এই প্রকল্পে ওভারপাস, রাস্তা, পদচারী–সেতু (ফুটওভারব্রিজ), কালভার্ট নির্মাণ, গোলচত্বরসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ রয়েছে। ২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করা হচ্ছে সরকারি তহবিল থেকে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে মোট ব্যয়ের ৮০ শতাংশ সরকারি তহবিল এবং ২০ শতাংশ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা ছিল। তবে একনেকে অনুমোদনের সময় সম্পূর্ণ ব্যয় সরকারি তহবিল থেকে বহন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রকল্পের উন্নয়নকাজের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের বিমানবন্দর সড়কে ৬০০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। ৩৮টি পদচারী–সেতুতে ব্যয় হবে ৫৮ কোটি টাকা। ১৪টি সেতু নির্মাণে ৫৬ কোটি টাকা এবং ২২টি কালভার্টে ব্যয় ১৪ কোটি টাকা। ১০টি গোলচত্বরের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১২ কোটি টাকা। আর ৭৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার উন্নয়নে ব্যয় হবে ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ৫৭ কোটি টাকা। সেবা সংস্থার পাইপলাইন অপসারণে খরচ হবে ২০ কোটি টাকা।