আইন–অধিকার

পরিবেশ রক্ষায় আইনের দুর্বলতা, প্রয়োগেও শিথিলতা

আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য নানা কারণে পরিবেশ রক্ষা করা বা পরিবেশদূষণ রোধ করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। এর অন্যতম কারণ হলো, এখানে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশকে এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এর পাশাপাশি পরিবেশসংক্রান্ত আইনের দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নানা রকম শিথিলতা রয়েছে।

আমাদের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় আমাদের একাধিক আইনও রয়েছে। এর একটি হলো, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫। এ আইন পরে সংশোধন করা হয়, যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ নামে পরিচিত।

এ আইন অনুসারে, ‘পরিবেশ’ অর্থ পানি, বায়ু, মাটি ও ভৌত সম্পদ এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কসহ এদের সঙ্গে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক। ‘দূষণ’ অর্থ বায়ু, পানি বা মাটির তাপ, স্বাদ, গন্ধ, ঘনত্ব বা এদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনসহ বায়ু, পানি বা মাটির দূষিতকরণ বা এদের ভৌতিক, রাসায়নিক বা জৈবিক গুণাবলির পরিবর্তন অথবা বায়ু, পানি, মাটি বা পরিবেশের অন্য কোনো উপাদানের মধ্যে তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, তেজস্ক্রিয় বা অন্য কোনো পদার্থের নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু, পানি, মাটি, গবাদিপশু, বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ, গাছপালা বা অন্য সব ধরনের জীবনসহ জনস্বাস্থ্যের প্রতি ও গৃহকর্ম, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, বিনোদন বা অন্যান্য ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক, অহিতকর বা ধ্বংসাত্মক কার্য।

পরিবেশসংক্রান্ত অপরাধ বিচার করার জন্য ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০। প্রতিটি জেলা সদরে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা করার কথা রয়েছে আইনে। পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০-এর ৫ ধারানুযায়ী সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রতি জেলায় এক বা একাধিক স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এ আইনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি এ আইনের অধীন আদালতে বা থানায় মামলা করতে পারেন না। এ আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে পারেন বা থানায় এজাহার করতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবেশবিরোধী কাজ করেন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মামলাই হয় না। সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকাটা এ আইনের একটি দুর্বলতা বলে মনে করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।

কলকারখানার বর্জ্যে নদীদূষণ, যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ, রাস্তা বা নতুন কোনো স্থাপনার জন্য গাছপালা কেটে ফেলা কিংবা পলিথিনের উৎপাদন ও যথেচ্ছ ব্যবহার—আমরা প্রায় প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা নিজেরা সরাসরি দেখি কিংবা অন্যদের কাছ থেকে জেনে থাকি। এ ধরনের প্রতিটি কাজই পরিবেশদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। গত কয়েক বছরে দৃশ্যমানভাবে পরিবেশদূষণের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় পরিবেশ আদালতে মামলা করার সংখ্যা অনেক কম। পরিবেশ রক্ষায় কর্তৃপক্ষ যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারছে না, সেটা খুব স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি ‘যুগান্তকারী’ রায় দেন। সরকারের অনুমতি নিয়ে রাজধানী তেজগাঁও এলাকায় আলকাতরা ও ন্যাপথলিন উৎপাদন করে আসছিল একটি প্রতিষ্ঠান। আলকাতরার গন্ধ ও দূষিত পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ অধিদপ্তরে দরখাস্ত করে। তদন্ত শেষে পরিবেশ অধিদপ্তর কারখানার উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। আলকাতরা উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানটি হাইকোর্ট বিভাগে রিট (পিটিশন নম্বর ৮৬৪৪/২০১৮) করলে বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন। পরিবেশ রক্ষায় উচ্চ আদালত এর আগে বেশ কিছু যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। একটি মামলায় আদালত (৫৫ ডিএলআর ৬৯) বলেন, বেঁচে থাকার অধিকার বলতে এটাও বোঝায়—পরিবেশদূষণ থেকে বেঁচে থাকা।

সোলায়মান তুষার আইনজীবী