চট্টগ্রামের রন্ধনশিল্পী জুবায়দা আশরাফের রান্না করা মধুভাত
চট্টগ্রামের রন্ধনশিল্পী জুবায়দা আশরাফের রান্না করা মধুভাত

চট্টগ্রামের সুস্বাদু মধুভাত 

ডুলার ভিতর লুকাই রাইখ্যি/ আঁওন ধানর জালা/ ভাদো মাসত নিশি রাইতত/ নাইরকুল হাডের খালা/ বেইন্না উডি বিছাই দিবো/ মধুভাতর থালা। 

(ডুলার ভেতরে আমনের বীজধান লুকিয়ে রেখেছি। ভাদ্র মাসের রাতে নারকেল কুটছে খালা। সকালবেলা থালায় করে মধুভাত পরিবেশন করবেন) 

মধ্য অগ্রহায়ণের এক নাতিশীতোষ্ণ দিনে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শৈশবের এক উৎসবকে ফিরে পেয়েছি। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে পটিয়া উপজেলার মনসা গ্রামে সেদিন খুঁজে পেলাম কয়েক দশক আগের একটি দিনকে। গ্রামে গিয়েছিলাম মাছের লোভে। হেমন্তের শেষে শুকিয়ে যাওয়া বিলের ধারে ছোট জলাশয় সেচে প্রচুর কই, মাগুর, শিং মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু গিয়ে পেলাম বাড়তি মজা। চাচাতো ভাই কিবরিয়া বলল, ‘আপনারা আসছেন যে ভালো হইছে। আজ বাড়িতে মধুভাত বসাইছে। সবাই মিলে মজা করে খাব।’ তার প্রস্তাবে মনটা চলে গেল দূর অতীতে। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বছরের যে কয়টা দিন নানা কারণে উৎসবমুখর হতো, তার মধ্যে মধুভাতের উৎসব অন্যতম। লম্বা একটা চাটাইয়ে ছোটরা লাইন ধরে বসতাম। সামনে থাকত টিনের খালি বাসন। সেই বাসনে বড় একটা ডেকচি থেকে আমাদের মধুভাত দেওয়া হতো।

বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখলাম সেই আগের দিনের দৃশ্য। চাটাইয়ের বদলে টেবিল–চেয়ার। টিনের বাসনের পরিবর্তে চিনামাটির প্লেট। বড় একটি বাটিতে নারকেলমাখা মধুভাত রাখা হয়েছে। আমরা লোভ সামলাতে না পেরে বসে গেলাম ছোটদের সঙ্গে। ছোটরা আমাদের পেয়ে খুব খুশি।

কিবরিয়া বলল, মধুভাত আগের মতো এখন ঘরে ঘরে রান্না হয় না। এটা রান্নার প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ, সময়সাপেক্ষ।

মনে পড়ে গেল মধুভাতের রাতের কথা। এর আয়োজন চলত রাতে, যাতে কেউ না জানে, না বোঝে। কারণ, বেশি লোক দেখে ফেললে বা জানাজানি হলে মধুভাত জমে না বলে তাদের বিশ্বাস। তবে আমরা দেখতাম কেউ নারকেল কাটছেন, কেউ বড় ডেকচিতে ভাত রান্নার পর সেটিকে ঘুঁটার কাজ করছেন। নানা প্রক্রিয়া শেষে মধুভাত তৈরি হলে সকালে খাওয়া হয়। 

মধুভাত খেলে একটু ঝিমুনি ভাব আসে। এ নিয়ে মজার গল্প প্রচলিত আছে। সেকালের চট্টগ্রামের পুরুষেরা জীবিকার তাগিদে রেঙ্গুন ও আকিয়াব যেত। ঘরের নারীরা তাদের যেতে দিতে চাইত না। অনেক বউ যাওয়ার দিন স্বামীকে বেশি করে মধুভাত খাইয়ে দিত। খেয়ে তার ঘুম পেত। তাই বিদেশ গমন স্থগিত রাখত। তাতে মনের মানুষটাকে আরও একটা দিন পাওয়ার সান্ত্বনা পেত তারা। এর জন্য অবশ্য পাড়াপড়শির কানাঘুষা কম থাকত না।

মধুভাতর নেশা গরি/ ঘুমত রইয়ি জামাই/ কেনে যাবি কেনে খাবি/ আক্কিয়াবর হামাই। 

(মধুভাতের নেশায় জামাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কীভাবে সে আকিয়াব যাবে, টাকা কামাই করবে)

কীভাবে তৈরি হয়

অঙ্কুরিত ধান থেকে পাওয়া চালের গুঁড়, বিন্নি চাল অথবা পোলাওয়ের চাল, মধু, চিনি এবং নারকেল হলো মধুভাতের উপকরণ। বর্ষার শুরুতে আমন ধান পানিতে ভিজিয়ে যেভাবে বীজ ধান গেঁজানো হয়, ঠিক সেভাবে মধুভাতের জন্য ধানের বীজ গেঁজাতে হয়। অঙ্কুরিত হওয়ার পর ধানগুলো স্তূপ করে রাখা হয় নয়–দশ দিন। অঙ্কুরিত গেঁজ শুকিয়ে এলে টুকরিতে কাপড় দিয়ে ১৫ দিন এরপর রোদে শুকিয়ে ঢেঁকির সাহায্যে চাল বের করা হতো। এখন অবশ্য মেশিনেই চাল হয়।

বিন্নি অথবা পোলাওয়ের চাল দিয়ে প্রথমেই রান্না করা হতো জাউভাত। জাউভাত রান্নার পর সেগুলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুঁটতে হয়। জাউভাত ঘুঁটা শেষ হয়ে গেলে সেখানে মধু ও চিনি মেশানো হয়। এরপর মেশানো হয় বীজধান বা জালাধানের চালের গুঁড়া। যে পরিমাণ বিন্নি বা পোলাও চাল দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ দিতে হবে গুঁড়া। সব গুঁড়া একসঙ্গে মেশানো যায় না। অল্প অল্প মেশাতে হবে। কিছু মেশানো শেষ হলে তারপর আবার দিতে হয়। এভাবে কয়েকবার করে জালা চালের গুঁড়া মেশাতে হয়। মেশানোর পর গরম থাকতে থাকতে ঢাকনা দিয়ে মোটা কাপড়ে মুড়িয়ে দিতে হয়, যাতে ভাতের ভাপ বেরিয়ে না যায়। এ অবস্থায় কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা থাকার পর সকালে এটি খাবারের উপযোগী হয়। তখন তাতে নারকেল মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।

চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা বইয়ে চট্টল–গবেষক আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে নববিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম বছর মধুভাত পাঠানো বাধ্যতামূলক। মধুভাত খেতে মধুর মতো সুমিষ্ট ও তৃপ্তিদায়ক যেমন, তেমনি তার সুঘ্রাণ। মধুভাত খাওয়ার পর ঘুম ঘুম ভাব হয়। সে এক অনাবিল প্রশান্তি।’

সেই প্রশান্তি, সেই সুঘ্রাণের সকাল সত্যি ফিরে এসেছিল যেন সেদিনের মধুভাতে।