আহমদ রফিক
আহমদ রফিক

যেভাবে কাটছে তাঁর দিন

এখনো পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছর আগেকার যেকোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেকোনো অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে পারেন সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আপনা-আপনিই একটা গানের নিভৃত ধ্বনি শুনতে পাই, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী,/ আমি অবাক্‌ হয়ে শুনি কেবল শুনি…।’ আদতে তিনি গান গাইতে পারেন না, এখন শোনেনও না। কিন্তু অসংখ্য রবীন্দ্রগান-কবিতার পঙ্‌ক্তি গেঁথে দেন কথার পিঠে পিঠে। তিনি আহমদ রফিক। বায়ান্নর জীবিত ভাষাসংগ্রামীদের একজন। তিনি একাধারে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, শতাধিক গ্রন্থপ্রণেতা, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কবি ও সম্পাদকও। এখন ৯৫ বছর অতিক্রান্তের পথে রয়েছেন।

সপ্তাহখানেক আগে তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন বসন্তকাল আসি আসি করছে।  মাত্র দুই দিন বাকি। কিন্তু তিনি জানেন না এখন কোন মাস চলমান। ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাস এলেই লেখক-সম্পাদক-গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় বেড়ে যায় তাঁর দুয়ারে। লেখা চেয়ে অনুরোধ, সাক্ষাৎকারের চাপ, ক্যামেরার সামনে কথা বলার প্রস্তুতি নিতে নিতে তিনি জেরবার। সেসব এখন অতীত। বছর তিনেক থেকে আর তেমন কেউ ভেড়েন না তাঁর দুয়ারে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রায় অর্ধেক তো শেষ হয়ে এল বলতেই, ‘ও, তাই নাকি? ফেব্রুয়ারি মাস চলছে? আমি তো বুঝতেই পারিনি! ’—বললেন তিনি।

আমাদের বুঝতে বাকি রইল না, ফাগুন এলেই থেকে থেকে ডাকার মতো করে তাঁর ঘরে আর তেমন কেউ কলরব করতে আসেন না। সাংবাদিক-গবেষক, শুভানুধ্যায়ীদের ভিড় জমে না এখন রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের গাউস নগরের ‘অপরাজিতা’য়। ‘স্বজনহীন’ এ তল্লাটে তিনি আছেন দুই সার্বক্ষণিক গৃহকর্মীর পরম যত্নে। তাঁরাই তাঁর সত্যিকারের আপনজন।

আহমদ রফিকের চারদিকে আজ যেন কেবলই শূন্যতা। বয়স তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে না পারলেও শরীর ভেঙে পড়েছে বেশ। শরীরে বাসা বেঁধেছে বয়সজনিত জরা; রয়েছে অর্থনৈতিক সংকটও। কারও সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারেন না এক পা–ও।  দৃষ্টিশক্তির ক্ষয়িষ্ণুতা কেড়ে নিয়েছে তাঁর লেখার সামর্থ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রুতশক্তির খর্বতা। তাই কুশল জানতে চেষ্টার পর তাঁর জবাব, ‘ভালো না! ভালো না! ভালো না!’ তাঁর ভালো না থাকাটাও যে একটা খবর হতে পারে, আজকাল সে খবর নেন না তেমন কেউই।

একজন সার্বক্ষণিক লেখকের জীবনে একাকিত্ব দুর্বিষহই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি বলছেন, ‘এক অর্থে এটা ভালো যে লোকজন আসছে না। তাতে পরিশ্রম কমে গেছে। আরেক অর্থে অসহনীয়। কেউ আসে না, খোঁজ নেয় না। পৃথিবীতে কেউ এ জীবন চায় না।’

আহমদ রফিক এই জীবন চাননি। মাঝেমধ্যে তাঁর মনে হয়, ‘আমি কি লেখক হিসেবে পরিত্যক্ত? আমার যা দেবার, দিলাম। কতটুকু পেলাম কি পেলাম না, সেটি ভাবা আমার কাজ নয়। তবু এই ভাবনাগুলো সামনে আসে। তবে এতটুকু আত্মবিশ্বাস আছে যে কেউ বলতে পারবেন না, আমি তেমন কিছুই দিইনি। আমার সোনালি সময়ে লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে উজাড় করে দিয়েছি।’

আহমদ রফিক কামনা করতেন, তাঁর বড় সম্পদ চোখ যেন কোনোভাবেই দৃষ্টিশক্তিহীন না হয়।  বললেন, ‌‘সব সময় বলতাম, চোখই আমার জীবন। সেটা তো আর রইল না, নষ্ট হয়ে গেল। অথচ হাতে এখনো লিখতে পারি। কিন্তু কী লিখি, কোথায় লিখি, তা তো বুঝতে পারি না।’ তবু জিজ্ঞেস করা, ভাষার মাস বলা হয় ফেব্রুয়ারিকে। এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলতে চান কি না? তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘কেবলই আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া একুশের চেতনার আর কোনো মূল্য নেই। সর্বস্তরে বাংলা চালুর অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার আমি। এর তাৎপর্য নিয়ে কথা বলতে গিয়েছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কাছে গিয়েছি। পাত্তা দেননি। রাষ্ট্রভাষা জাতীয় ভাষা হলো না। জীবিকার ভাষা হলো না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাগুলো সংরক্ষণের তেমন উদ্যোগ নেই। সুতরাং একুশের চেতনার তাৎপর্য কেবল মুখে মুখে।’

কথায় কথায় এই ভাষাসংগ্রামী জানালেন নিজের অতৃপ্তির কথা, একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন। সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণাধর্মী বই লিখতে চেয়েছিলেন; প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও লেখা হলো না। সম্রাট আকবর ও আবুল ফজলকে নতুন চিন্তায় আবির্ভূত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না।

ফেরার সময় মনে হলো, আহমদ রফিক এখন এক বয়স্ক শিশু ভিন্ন কেউ নন; যেন তাঁর ক্ষেত্রেই নজরুলের এই গান প্রাসঙ্গিক, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে...নিত্য তুমি, হে উদার/ সুখে দুখে অবিকার;/ হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে॥’