একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাংবিধানিক দায়িত্ব। গাইবান্ধার উপনির্বাচনে তা করতে পারেনি ইসি। বিপুল অর্থ ব্যয় করে একটা ভোটের আয়োজন করে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে ইসি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে, ওই আসনে পুনরায় উপনির্বাচন করতে হবে। আবারও দেশের মানুষের করের টাকা খরচ হবে।
ভোটের আগে নিয়মমতো ইসি রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে, ভোটের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত করেছে। অর্থাৎ প্রক্রিয়াগতভাবে ইসির কোনো ঘাটতি ছিল না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে ভোটটা পণ্ড হলো কেন? কে ইসিকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দিল না?
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোট গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, ভোট গ্রহণ নিরপেক্ষ হচ্ছে না।’
এই পরিস্থিতিতে গাইবান্ধার উপনির্বাচন বাতিল করে দিয়ে ইসি তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা (নিউক্লিয়ার অপশন) প্রয়োগ করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এর পরের ধাপ কী। ভোট পণ্ড করার পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করা, শাস্তির আওতায় আনা। ইসি কি সেটা পারবে বা করবে? এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ইসির। তাকে ভোটের সরঞ্জাম সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। সংবিধান অনুসারে, ইসিকে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের সব ধরনের সহায়তা দিতে সরকার বাধ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার অর্থাৎ গাইবান্ধার স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসিকে কি সংবিধান মেনে সহায়তা দিয়েছে? কারণ, ভোট বন্ধ করা ইসির ক্ষমতার মধ্যে পড়লেও সেটা তাদের মূল কাজ নয়। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সময়মতো, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন করা।
গাইবান্ধায় ভোট বাতিল করে ইসি যদি দায়ীদের কোনো শাস্তির আওতায় না আনে, তাহলে মনে করতে হবে যে পুরো দায় ইসি নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। এটা হলে তা হবে খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। কারণ, ইসি হতাশ কিংবা ক্ষুব্ধ হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিংবা অন্যের অপরাধের দায়ও নিজের ওপর নিতে পারে না। সংবিধান ভোট পণ্ডে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ইসিকে দিয়েছে। শুধু প্রয়োগ করার ব্যাপার।
সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকারসহ বেশির ভাগ নির্বাচনেই মারামারি, হতাহতের ঘটনা দেখা গেছে। আবার ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে অযাচিত লোকজনের ভিড়, একজন অন্যজনের ভোট দিয়ে দেওয়া, নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে। গাইবান্ধার উপনির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বুধবারের ভোটে সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। তবে ইসি বুথে স্থাপন করা সিসি ক্যামেরায় গোপন কক্ষে অযাচিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখেছে। বুথের ভেতরের নিয়ন্ত্রণ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনের হাতে ছিল।
এখন জানার বিষয় হচ্ছে, অযাচিত লোকদের গোপন কক্ষ বা ভোটকেন্দ্র থেকে বের করার জন্য ইসি কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছিল? যদি না চায়, তাহলে ধরে নিতে হবে, ইসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা পায়নি। আর যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সহায়তা চেয়ে না পেয়ে থাকে, তা হবে খুবই গুরুতর।
দুপুরের মধ্যে ৫১টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। পরে পুরো আসনের ভোট বাতিল করা হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা আইনের আওতায় এনেছে বলে শোনা যায় না। এসব প্রশ্নের সুরাহা না করতে পারলে ইসির জন্য ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন করা কঠিনই হবে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ৩০০ আসনের ভোট তো নিশ্চয়ই ইসি বাতিল করতে পারবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। গাইবান্ধায় অবশ্য জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে। ওই আসনে দলটির একটা ভোটব্যাংক আছে বলেই মনে করা হয়। অর্থাৎ বিএনপি ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটা ভোটের সুযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত কার ব্যর্থতায় এই ভোট পণ্ড হলো, তা ইসির খুঁজে বের করা প্রধান কাজ হওয়া উচিত, যা তাদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করবে।
বর্তমান ইসি গঠিত হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এর মধ্যে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন এই ইসির প্রথম জাতীয় সংসদ ভোট। আগামী ৫ নভেম্বর ফরিদপুর-২ আসনে আরেকটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দুটি নির্বাচন নিয়েই সমালোচনা আছে। এই দুটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
এ জন্য বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্তমান ইসিকেও আস্থায় নিচ্ছে না। বিরোধী অনেক দল প্রথমে ইসি গঠনপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ডাকা সংলাপে এবং পরে নতুন ইসির সঙ্গে মতবিনিময় সভা বর্জন করেছে। অর্থাৎ অতীত অভিজ্ঞতায় বিরোধী দলগুলো মনে করছে, বর্তমান ব্যবস্থায় ইসির অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না।
রাজনৈতিক ভাষ্যকরেরা মনে করেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে ইসিতে নিজের ক্ষমতা দেখানোর একটা তাড়না ছিল। আর এই ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে টুকটাক প্রশ্ন ছোড়া হলেও জোরালো কোনো প্রতিবাদ করা হবে না বলেই মনে হয়। গাইবান্ধায় ভোট বাতিল করে ইসি কি তাহলে অনেকটা ‘নিরাপদ’ হুংকার ছেড়ে নিজেদের শক্তি দেখিয়েছে? তবে গাইবান্ধার ভোট পণ্ডকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসি সত্যিকারের শক্তি দেখাতে পারে। সেটা ইসি করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।