দিনভর শহরে দুধ বিক্রি করে সংসার ও নিজের পড়াশোনার খরচ চালান বাগেরহাটের দেব প্রসাদ শীল (২৩)। জন্মগতভাবে দুটো হাত সরু ও লম্বায় মাত্র বুকসমান কিশোরগঞ্জের মো. নয়ন মিয়ার (১৯)। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রেন চং ম্রোর ঝুলিতে ফুটবল নিয়ে কারিকুরিতে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানো। ওই তিনজনই এখন এক ছাতার তলে খেলছেন হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ বা গৃহহীনদের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে।
প্রথমবারের মতো গৃহহীনদের জন্য আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেব, নয়ন ও প্রেনসহ মোট ২৫ জনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে গৃহহীনদের বিশ্বকাপের জন্য। চূড়ান্ত পর্বে টিকে থাকবেন ৮ জন খেলোয়াড়।
‘সবার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ‘হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৩’ শুরু হবে এ বছরের ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে। শেষ হবে ১৫ জুলাই। এই প্রতিযোগিতার আয়োজক হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দলকে ক্যালিফোর্নিয়া নিয়ে যাবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স (শি)।
বিশ্বের ৭০টি দেশে ‘হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ’-এর সদস্য রয়েছে। প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রতিটি দেশে একটি সংস্থাকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সদস্য পদ দেওয়া হয়। গত বছরের আগস্ট মাসে হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশনের সদস্য পদ পান শি।
হোমলেস বা গৃহহীন কারা, তার একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশন। সেই সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো বাড়িঘর নেই বা রাস্তায় ঘুমিয়ে রাত কাটাতে হয় এমন ব্যক্তিরাই শুধু গৃহহীন নন, কোনো ব্যক্তির আবাসনে যদি পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকে, সেই ব্যক্তিকে প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর হিসেবে গৃহহীন ধরা হবে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির আবাসন যদি তাঁকে নিরাপত্তা না দেয়, যদি তাঁকে উচ্ছেদ আতঙ্কে বা হুমকির মধ্যে থাকতে হয়, আবাসনে যদি নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, রান্না করা ও খাবার মজুত করার মতো সুযোগ-সুবিধা না থাকে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তির আবাসন পর্যাপ্ত নয় বলে বিবেচনা করে ওই ব্যক্তিকেও গৃহহীন ধরা হবে।
শি-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সবার খেলাধুলার অধিকার রয়েছে। গৃহহীন প্রান্তিক মানুষের খেলাধুলার অধিকারের কথা তুলে ধরতেই এ আয়োজন। প্রথমবার বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাচ্ছে, এটা আনন্দের বিষয়। শি-এর অংশ হতে পেরে গর্বিত। এবার শুধু ছেলেদের দলকে পাঠানো হচ্ছে। মেয়েদের ফুটবল দল প্রস্তুত করা যায়নি। আগামী বিশ্বকাপে ছেলে ও মেয়ে দুটো দলকেই পাঠানোর আশা করছেন তাঁরা।
সব বাধা পেরিয়ে খেলেন তাঁরা
গৃহহীনদের বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশ দলটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শি হোমলেস টিম’। শি-এর বাছাই দলের একজন হচ্ছেন শ্রীমঙ্গলের ইমন চাষা (১৯)। আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ইমন জানালেন, তাঁর বাবা-মা শ্রীমঙ্গলের ইছামতী চা-বাগানের শ্রমিক। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছোট। অর্থসংকটে এসএসসি পাসের পর পড়ালেখা থেকে দূরে সরে গেছেন। এখন বাড়িতে দুটো গরু লালন-পালন করেন। ফুটবল খেলা তাঁর নেশা। ছোটবেলা থেকেই খেলছেন।
গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে দুধ কিনে নিয়ে প্রতিদিন শহরে গিয়ে বিক্রি করেন দেব প্রসাদ শীল (২৩)। দিনে ২০০-২৫০ টাকা লাভ থাকে। সেই টাকায় জোড়াতালি দিয়ে সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালান। দেবের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের বেতাগা গ্রামে। থাকেন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িতে। দেব প্রথম আলোকে জানান, তিনি শেখ হেলালউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়ছেন। এ বছর তাঁর দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা জোগাড় করতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। বই কেনা ও শিক্ষকের কাছে টিউশন নিতে হয়, সেটাও করতে পারেননি। এখন ভাবছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে দেব চতুর্থ। তিনি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে গিয়ে ফুটবল ও রাগবি খেলেন। গৃহহীন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলে ঠাঁই পেতে নিজের সেরাটা খেলার চেষ্টা করবেন বলে জানালেন।
জন্মগতভাবে দেহের তুলনায় দুটি হাত ছোট মো. নয়ন মিয়ার (১৯)। প্রতিবন্ধিতাকে ছাপিয়ে পড়ালেখা ও খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছেন। নয়নের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যোশদল ইউনিয়নের শহীদনগর গ্রামে। তিনি স্থানীয় ওয়ালীনেওয়াজ খান কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছেন। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। বাবা রুহুল আমিন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। নয়ন বললেন, ছোটবেলা থেকে তিনি ফুটবল খেলেন। তবে হাত ছোট হওয়ায় রক্ষণভাগ বা গোলরক্ষক হিসেবে কখনো খেলা সম্ভব হয়নি তাঁর। তিনি একজন স্ট্রাইকার।
প্রেন চং ম্রো (২৪) ‘মোস্ট ফুটবল টো ট্যাপ ইন ওয়ান মিনিট’ অর্থাৎ এক মিনিটে পায়ের আঙুল দিয়ে সবচেয়ে বেশিবার বল ‘ট্যাপ’ করে তিনি বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। তিনি এক মিনিটে ২০৮ বার ট্যাপ করেছেন। গত বছর নভেম্বরে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে স্বীকৃতি দেয়। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ম্রো-এর একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে বাছাইপর্বে নেওয়া হয়েছে। প্রেন জানালেন, তাঁর বাবা-মা মারা গেছেন। বড় ভাই-ই তাঁর পরিবার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। তাঁর বাড়ি বান্দরবান সদর উপজেলার ৪ নম্বর সুয়ালক ইউনিয়নের লামারপাড়া গ্রামে।
এবার গৃহহীনদের বিশ্বকাপে ছেলেদের ৪৮টি দল এবং মেয়েদের ১৬টি দল অংশ নেবে। প্রতি দলের ৪ জন করে খেলোয়াড় মাঠে খেলতে পারবেন। মোট ১৪ মিনিটের ম্যাচ ‘স্ট্রিট সকার’-এর নিয়ম অনুযায়ী খেলা হবে।
শি-এর ক্রীড়া উন্নয়ন বিভাগের প্রধান পাপ্পু লাল মোদক প্রথম আলোকে বলেন, স্ট্রিট সকার খেলার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এই নিয়মের প্রধান বিষয় হচ্ছে, অল্প জায়গায় কীভাবে খেলা যায়। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে অপর্যাপ্ত বাসস্থানে বসবাসরত দরিদ্র ২৫ জন প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবল খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়েছে সংস্থার স্থানীয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। প্রাথমিক দলের মধ্যে দুজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫ জন এবং সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী একজন খেলোয়াড়ও রয়েছেন।
পেলের স্মরণে প্রীতি ম্যাচে জয়ী হোমলেস টিম
কিংবদন্তি ফুটবল খেলোয়াড় সদ্য প্রয়াত ব্রাজিলের এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, যিনি পেলে নামেই পরিচিত, তাঁর স্মরণে আজ জিমনেসিয়াম মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দলের সঙ্গে শি হোমলেস টিমের বাছাই দলের প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এ ম্যাচে টাইব্রেকারে জয় পেয়েছে শি হোমলেস টিম।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলার নির্ধারিত সময়ে প্রথমার্ধে প্রতিবন্ধী মো. নয়ন মিয়া গোল করে শি হোমলেস টিমকে এগিয়ে নেন। দ্বিতীয়ার্ধে একটি পেনাল্টিসহ দুটি গোল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেন জিলানুর রশীদ ও মুহিব্বুল্লাহ রাফি নামের দুই খেলোয়াড়। শেষ বাজি বাজার আগমুহূর্তে শি হোমলেস টিমের প্রেন চং ম্রো গোল করে খেলায় সমতা আনেন। পরে টাইব্রেকারে প্রেনের দল পেনাল্টিতে ৫টি গোল করতে পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিম ৪টি গোল করতে পারে।
প্রীতি ম্যাচে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি খেলোয়াড়দের হাতে কাপ ও মেডেল তুলে দেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা অন্যতম মানবাধিকার। আমাদের দেশে এ অধিকার ক্রমে সঞ্চিত হয়ে আসছে, যা মানসিক বিকাশে অন্তরায় হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শি যৌথভাবে এ খেলার আয়োজন করে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার অবারিত দ্বার উন্মোচন থাকবে। যে ধরনের সামাজিক অবস্থান হোক না কেন, প্রত্যেকের খেলার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্রকে।